মঙ্গলবার, জুন ২৪, ২০১৪

বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম কি থেমে যাবে?


'দুটি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়'- বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এই স্লোগানে সরকার যখন নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে, তখন দেশটির খোদ প্রধানমন্ত্রী বলছেন, তিনি এই নীতির পরিবর্তন চান। তিনি দুটি করে সন্তান নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাই প্রশ্ন উঠছে, প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম কি বাধাগ্রস্ত হবে? সাধারণ মানুষই বা বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?ছয় সন্তানের মা সখিনা বেগম। থাকেন রাজধানীর তেজগাঁওয়ে রেললাইন বস্তিতে। ছয় সন্তান জন্মানোর পর তার স্বামী আরেকজনকে বিয়ে করে অন্যত্র চলে যান। ফলে সাতজনের সংসার সামলানোর পুরো ভার এসে পড়ে সখিনার ওপর। কিন্তু এ নিয়ে তারে কোনো খেদ নেই। বস্তির অদূরেই কারওয়ান বাজারে সবজি বিক্রি করে সংসার চালান।
সখিনা বলছেন, ''মনে করেন ৫০০ টাকা রুজি অইলে ৫০০ টাকার মাছ তো কিনতে পারি না। পোলাপানের চাহিদা মতো খাওয়াইতে পারি না। ডাইল ভাত শাক ভাজি খাই। আমার ১০টা পোলাপান হইলে কি ফালাইতে পারতাম? যদি ল্যাংড়াও হইত আমি কি আমার মুখ দিয়া কইতে পারতাম আমার পোলাপান ল্যাংড়া?'
তার পাশে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলেন এই বস্তিরই আরেক নারী শিউলি, যিনিও একাধিক সন্তানের মা, তিনি মনে করেন, অধিক সন্তান কোনো সমস্যা নয়।
শিউলি বললেন, ''বড়লোকেরা ট্যাকার ধান্দায় থাকে। হ্যারা ট্যাকার পাগল। পোলাপান রাইখা খালি ট্যাকা কামায়। আমরা কি হ্যাগো মতো ট্যাকার পাগল? পোলাপান হইছে গিয়া আমাগো কাছে সম্পদ। পোলাপান মানুষ করেত পারলে হ্যারা সম্পদ। এহন সব তো মানুষ হয় না। দুয়েকটা অমানুষও হয়। হাতের পাঁচ আঙুল কি সমান হয়?''
অবশ্য এই ধারণার সঙ্গে একমত নন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নেটওয়ার্কিং ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত খন্দকার ফাইজুস সালেহীন। যিনি গত বছরেই বিয়ে করেছেন এবং তার স্ত্রী এখন সন্তানসম্ভবা। মি. সালেহীন বলছেন, তারা বাস্তবিক কারণেই এক সন্তানের পক্ষে।
তিনি বলেন, ''আমরা আসলে একটি সন্তান নেয়ারই পক্ষে। কারণ আমাদের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। তাছাড়া ঢাকায় বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করানো এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আমার স্ত্রী এখনও চাকরি করেন না। বাট শি ইজ লুকিং ফর এ জব। সুতরাং আমরা দুজনই যখন চাকরি করব, তখন তো একাধিক সন্তান পালন করা সম্ভব হবে না।''
সর্বশেষ আদমশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি ৭০ লাখ। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১০১৫ জন মানুষ বাস করে। বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭%।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সম্পদের তুলনায় অধিক জনসংখ্যা বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে বড় বাধা।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে দুটি সন্তান নেয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, যেসব দেশ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এক সন্তান নীতি নিয়েছিল, তারা এখন বৃদ্ধের রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। অধিক জনসংখ্যা বোঝা নয় উল্লেখ করে তিনি জনগণকে প্রশিক্ষিত করে সম্পদে পরিণত করার তাগিদ দেন।
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে কীভাবে দেখছেন জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ কে এম নুরুন নবি? প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে চলমান কর্মসূচি কি ব্যাহত হবে?
মি. নুরুন নবি বলছেন, ''আমাদের এখানে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারে দেখবেন একটি বা দুটির বেশি সন্তান নেই। কিন্তু বস্তিতে, চর এলাকায় বা হাওরে অধিক সন্তান জন্ম নিচ্ছে। তো এই জনসংখ্যার জন্য যদি সঠিকভাবে অন্ন বস্ত্র শিক্ষা ও বাসস্থান নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে চাই সঠিক ব্যবস্থাপনা। এ কারণে আমরা বলি পরিকল্পিত পরিবারের কথা। অর্থাৎ একসঙ্গে অনেক সন্তান না নেয়া। তবে একটি সন্তান হলে ভালো হয়, ঢালাওভাবে এই কথা এখন বলা যাবে না।''
মোট জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম বৃহত্তম। ২০৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ২২ কোটিতে দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হয়।
এর ফলে মৌলিক প্রয়োজন যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, পানি বিদ্যুৎ সরবরাহসহ সব রকম সেবা ও অবকাঠামোর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হবে। এ কারণে স্বাধীনতার পর থেকেই জন্ম নিয়ন্ত্রণে সরকারিভাবেই উদ্যোগ নেয়া হয়।
তাই একের অধিক সন্তান না নিলে বাংলাদেশ বৃদ্ধের রাষ্ট্রে পরিণত হবে - এমন কথা বলবার সময় এখনও এসেছে কি না- তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের অনেকের মনেই সংশয় রয়েছে।-বিবিসি।