সোমবার, মার্চ ২৪, ২০২৫

ডিজিটাল প্লাটফর্ম বনাম বাস্তবতা










 পর্ব- ০২

অস্থির সময়: আমাদের রুচির অবক্ষয়

"ও-ই কিরে, ও-ই কিরে, মধু মধু রসমালাই রসমালাই আগুন আগুন..."— সাম্প্রতিক সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ধরনের শব্দগুচ্ছ ভাইরাল হয়ে উঠেছে। ফেসবুক, টিকটকসহ বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আজ এসব অযথা শব্দের চর্চায় নিমজ্জিত। প্রশ্ন জাগে, আমাদের আগ্রহের বিষয় ও রুচির কতটা অধঃপতন হলে আমরা এমন অর্থহীন বাক্যকে বিনোদন হিসেবে গ্রহণ করি? এই পবিত্র রমজান মাসেও আমরা কোরআন, হাদিস কিংবা আত্মশুদ্ধির কোনো আলোচনার পরিবর্তে এসব অর্থহীন ট্রেন্ড নিয়ে ব্যস্ত। সমাজ ও সংস্কৃতির এমন অবক্ষয় আমাদের গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলে।


আমরা এক হুজুগে প্রজন্মের সাক্ষী

আমি প্রায়শই নিকটজনদের কাছে বলি— আমরা এক অস্থির ও হুজুগে জেনারেশনের সাক্ষী হয়ে যাচ্ছি। আমাদের চারপাশের মানুষের রুচি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তাদের কাছে সভ্যতা, ভদ্রতা এবং শালীনতা কেবলই হাস্যকর বিষয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় যেকোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা হলেই দেখা যায়, সেখানে অশালীন মন্তব্য, ব্যক্তি আক্রমণ এবং অসংযত ভাষার ছড়াছড়ি। সম্মানিত ব্যক্তি হোন বা সাধারণ মানুষ, যদি কেউ কারও পছন্দসই কথা না বলে, তাহলেই শুরু হয় কুরুচিপূর্ণ আক্রমণ।

সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, যাকে-তাকে ‘তুই-তুমি’ বলে অসম্মান করা এখন যেন ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো ব্যক্তি বয়সে বড় হোক বা জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করুক, তাকে অবজ্ঞা করার প্রবণতা আমাদের সমাজে ভয়ংকরভাবে শেকড় গেড়েছে। তরুণ প্রজন্মের একাংশের ভাবখানা এমন যেন তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিদ্বান এবং তাদের মতের বাইরে কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ, প্রকৃত শিক্ষিত ও রুচিশীল ব্যক্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নম্রতা, সহনশীলতা ও বিনয়।


সোশ্যাল মিডিয়া: বিকৃত রুচির প্রকাশমঞ্চ

সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের চিন্তাকে আরও গতিশীল করতে পারত, সৃজনশীলতার জগতে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারত। কিন্তু বাস্তবে, এটি অনেকাংশে রুচিহীনতা, হীনমন্যতা এবং অপসংস্কৃতির চর্চার প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। এখনকার বেশিরভাগ ট্রেন্ডই হয় অশ্লীল, নয়তো অর্থহীন। সামাজিক অবক্ষয়ের সবচেয়ে বড় নিদর্শন হলো, মানুষ কোনো কিছু যাচাই না করেই শুধু বিনোদনের নামে যে কোনো কিছু ছড়িয়ে দিচ্ছে, লাইক-কমেন্ট-শেয়ারের প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

একটি উন্নত সমাজ গঠনের জন্য যেখানে প্রয়োজন শিক্ষা, শালীনতা, এবং মূল্যবোধ, সেখানে আমরা উল্টো পথে হাঁটছি। ট্রেন্ডের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা ভুলে যাচ্ছি আমাদের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত। একটা সময় ছিল, যখন তরুণ সমাজ দেশের ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখত, নতুন কিছু উদ্ভাবনের আকাঙ্ক্ষা রাখত। অথচ, আজ আমরা এমন একটি প্রজন্ম দেখছি, যারা মূলত বিনোদনের নামে অপসংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করছে।


সমাজ বদলাতে কী করণীয়?

এই পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব, তবে এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা ও ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা। আমরা যদি নিজেরাই সভ্য ও রুচিশীল আচরণ করি, তবে আশপাশের মানুষও ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হবে। আমাদের উচিত এমন কিছু প্রচার করা, যা মানুষের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বাড়ায়। ধর্মীয় শিক্ষা, নৈতিকতা ও মানবিক গুণাবলির প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে।অপ্রয়োজনীয় বিষয় নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষণীয় কনটেন্টকে ভাইরাল করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, একটি জাতির প্রকৃত উন্নতি নির্ভর করে তার সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ওপর। যদি আমরা সচেতন না হই, তবে অদূর ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ সামাজিক অবক্ষয়ের মুখোমুখি হতে হবে। তাই, আসুন আমরা হুজুগের পেছনে না ছুটে বাস্তব জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করি। 

ডিজিটাল প্লাটফর্ম বনাম বাস্তবতা

পর্ব- ০১












আন্তরিকতার উপাখ্যান


মানুষ সামাজিক জীব। দলবদ্ধভাবে বসবাস ও পারস্পরিক সহমর্মিতার মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে তার সভ্যতা। একসময় মানুষের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল পারস্পরিক সম্পর্ক, আত্মীয়তার বন্ধন, একে-অপরের প্রতি মায়া-মমতা। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে, বিশেষ করে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের বিস্তারের ফলে, এই আন্তরিকতার জগতে এক নতুন রূপান্তর দেখা যাচ্ছে।

আজকের পৃথিবীতে প্রযুক্তি আমাদের সংযুক্ত করেছে ঠিকই, কিন্তু সেই সংযোগে উষ্ণতার অভাব স্পষ্ট। একসময় যেখানে সম্পর্কের ভিত্তি ছিল ভালোবাসা ও সহমর্মিতা, সেখানে এখন কৃত্রিমতা আর লোকদেখানো মানবিকতা জায়গা করে নিচ্ছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এখন প্রয়োজনের আবেদনে আবদ্ধ, আন্তরিকতার বদলে স্বার্থ আর প্রতিযোগিতাই হয়ে উঠেছে মুখ্য।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আমাদের দূরত্ব ঘুচিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেইসঙ্গে আমাদের হৃদয়ের দূরত্বও যেন বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। মানুষ এখন একে অপরের পাশে থেকেও আসলে অনেক দূরে—ভার্চুয়াল জগতে যতটা সংযুক্ত, বাস্তব জীবনে ততটাই বিচ্ছিন্ন। মায়া-মমতা ও ভালোবাসার অভিব্যক্তি এখন 'রিঅ্যাকশন' আর 'কমেন্ট'-এর জালে সীমাবদ্ধ। ক্ষমতার লোভ, নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখানোর প্রবণতা, আর লোক দেখানো সহানুভূতি সমাজকে ঠেলে দিচ্ছে এক অদৃশ্য বিশৃঙ্খলার দিকে।

বর্তমান সমাজের প্রতিচ্ছবিতে বা মানুষের আচরনে সামাজিকতা কিংবা আন্তরিকতার বিপরীতমুখী গ্রাফের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের লক্ষণ ভালোভাবেই ফুটে উঠছে। মানুষের মধ্যে ক্রমশ একধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে—যা শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবে ও। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাচ্ছে, আত্মীয়তার সংজ্ঞা কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। একসময় যেখানে পরিবার ও প্রতিবেশীর সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করা ছিল স্বাভাবিক, সেখানে এখন নিজস্ব স্বার্থই হয়ে উঠেছে প্রধানতম দিক।

এই প্রবণতা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। সম্পর্কের উষ্ণতা কমে যাওয়ায় একাকিত্ব, হতাশা, এবং মানসিক অবসাদ বাড়ছে ক্রমাগত। কৃত্রিম জীবনের চাপে মানুষ সত্যিকারের আবেগ অনুভব করতেও যেন ভুলে যাচ্ছে। ভার্চুয়াল দুনিয়ার প্রশংসা আর স্বীকৃতির পেছনে ছুটতে গিয়ে বাস্তব জীবনে হারিয়ে ফেলছে "আন্তরিকতা"।

এর ফলে সমাজে সহমর্মিতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার অভাব তৈরি হচ্ছে প্রকটভাবে। কেউ বিপদে পড়লেও পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতা কমে যাচ্ছে, কারণ "নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত" থাকার সংস্কৃতি গভীরভাবে শিকড় গেড়ে ফেলেছে। আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে জন্ম নিচ্ছে অবিশ্বাস, ঈর্ষা ও অযৌক্তিক প্রতিযোগিতা, যার ফলে নষ্ট হচ্ছে সমাজের ভারসাম্য, নৈতিকতা ও মানবিকতা।

সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো, নতুন প্রজন্ম এই পরিবেশেই বেড়ে উঠছে। তারা প্রকৃত আন্তরিকতা কেমন, তা জানার সুযোগ পাচ্ছে না। পরিবার থেকে আন্তরিকতার শিক্ষা না পেলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সম্পর্কের সংজ্ঞা হয়তো শুধুই প্রয়োজনমাফিক ব্যবহার হয়ে দাঁড়াবে।

সুতরাং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট সত্যিকার অর্থে আন্তরিকতা কি এবং তা কিভাবে সামাজিক সম্পর্ক বির্নিমান করে, সে সম্পর্কে প্রচ্ছন্ন ধারণা দেওয়াটা অতীব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদেরকে অনুধাবন করাতে হবে যে, আন্তরিকতা সত্যিই একটা বিরল গুণ, যা কোনো সার্টিফিকেট, ট্যালেন্ট বা স্ট্যাটাস দিয়ে মাপা যায় না। এটা একদম হৃদয়ের গভীর থেকে আসে, কৃত্রিমতা দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না। যারা সত্যিকারের আন্তরিক, তাদের অনুভূতিগুলো মুখের ভাষার আগে প্রকাশ পায়, চোখের চাহনি, ব্যবহারে ধরা পড়ে। কিন্তু আজকের ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় অনেকে শুধুই উপস্থিতি দেখায়, সংখ্যার খেলা বাড়ায়, অথচ ভেতরে কোনো উষ্ণতা থাকে না। এটাই এখনকার এক বড় বাস্তবতা—অনেক সম্পর্ক কেবল স্ক্রিনের আড়ালেই থেকে যায়, আত্মার সংযোগ সৃষ্টি হয় না।

তবে আশার দিক হচ্ছে মানুষের এই রোবটিক জীবনের মাঝেও আন্তরিকতা একেবারেই হারিয়ে যায়নি, শুধু তা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সম্পর্কগুলোকে আবার নতুন করে উপলব্ধি করতে হবে, ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশকে কৃত্রিমতার মোড়ক থেকে বের করে আনতে হবে। সত্যিকারের মানবিকতা তখনই ফিরবে, যখন আমরা প্রযুক্তিকে নয়, মানুষকেই প্রাধান্য দেবো—মন থেকে, আন্তরিকভাবে।

আন্তরিক মানুষেরা সবসময় আলাদা, তাদের সংখ্যা কম হলেও তারা হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। আন্তরিকতা আসলে দূরত্ব বা মাধ্যমের ওপর নির্ভর করে না, বরং মানুষের ইচ্ছা, মানসিকতা, আর অনুভূতির গভীরতার ওপর নির্ভর করে। যদি সত্যিকারের সংযোগ গড়ার ইচ্ছা থাকে, তবে সেটা ভার্চ্যুয়াল হোক বা বাস্তব—সবখানেই সম্ভব।

অনেক সময় আমরা দেখি, বাস্তব জীবনেও মানুষ মুখোমুখি থেকেও অনুভূতিহীন হয়ে যায়, আবার কেউ কেউ হাজার মাইল দূরে থেকেও পরম আত্মীয়তার মতো পাশে থাকে। আসল ব্যাপারটা হলো বোঝার ক্ষমতা, সহানুভূতি, আর সম্মানের জায়গাটা ঠিক রাখা।

এখনকার সময়ে অনেক সম্পর্কই যেমন লেনদেনের মতো হয়ে গেছে—স্বার্থ থাকলে গুরুত্ব আছে, না থাকলে বিস্মৃতির ধুলায় ঢাকা পড়ে যায়। আন্তরিকতা, অনুভূতি, আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা যেন কৃত্রিমতার চাপে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত পরিবর্তনশীলতা ও ধৈর্যের অভাব, পরস্পরের প্রতি সত্যিকারের যত্ন নেওয়ার অভ্যাসও কমে যাচ্ছে। ভার্চ্যুয়াল দুনিয়া সম্পর্কগুলোকে সহজলভ্য করে তুললেও, অনেক ক্ষেত্রে এগুলো গভীরতা হারিয়ে ফেলে—যেন শুধু ‘অনলাইন স্ট্যাটাস’ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ!

তেমনি এর বৈপরীত্য ও পরিলক্ষিত হয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যেমন এখনো কিছু সম্পর্ক আছে, যেগুলো স্বার্থ ছাড়িয়ে গিয়ে হৃদয়ের গভীর থেকে আসে। যারা সত্যিকার অর্থে অনুভূতি বোঝে, তারা কৃত্রিমতার ফাঁদে আটকে যায় না। 

হ্যাঁ, একদম ঠিক! পৃথিবীতে এখনো ভালো মানুষ আছে বলেই আন্তরিকতা পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। যারা স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে সম্পর্ক গড়ে তোলে, যারা অন্যকে সত্যিকার অর্থে মানুষ হিসেবে দেখে—তাদের কারণেই এখনো ভালোবাসা, সম্মান, আর মানবিকতা বেঁচে আছে।

এই ভালো মানুষগুলোর সংখ্যা কম হলেও, তাদের অস্তিত্বই প্রমাণ করে যে আন্তরিকতা একেবারে বিলীন হয়ে যায়নি। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য দরকার সত্যিকারের বোঝাপড়া, ধৈর্য, আর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। যারা শুধু নেওয়ার জন্য আসে, তারা কৃত্রিমতার আবরণে ঢেকে যায়, কিন্তু যারা দেওয়ার মানসিকতা রাখে, তারা সম্পর্ককে জীবন্ত রাখে। তারা বর্তমান সমাজ ও সম্পর্ক গুলোকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নৈতিক, মানবিক ও আন্তরিক সমাজ বিনির্মানে তাদের অব্যাহত প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকে নিরলস।