শুক্রবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৫

মানবপ্রকৃতি ও প্রকৃতির নীরব প্রতিক্রিয়া


প্রকৃতি
কি এই অন্যায় নিরবে সহ্য করে? না। সে তো নীরব, কিন্তু অন্ধ নয়। সে দেখে—মানুষ কেমন করে খুন করে, নিপীড়ন চালায়, বিশ্বাসঘাতকতা করে, হিংসা ছড়ায়। প্রকৃতি হয়তো কাঁদে না, চিৎকার করে না—কিন্তু একসময় তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। তখন সে ঝড় হয়ে ওঠে—সিডর, আম্পান, ভূমিকম্প, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, খরা, বন্যা—সবই যেন মানুষের পাপের নিরব প্রতিক্রিয়া।

আজ প্রকৃতি ভারসাম্য হারিয়েছে—ঠিক যেমন মানুষ হারিয়েছে বিবেক। গ্রীষ্মে শীত, শীতে গ্রীষ্ম, আকাশের রঙে বিষন্নতা, বাতাসে গন্ধ নেই—সব মিলিয়ে প্রকৃতি যেন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে—“তোমরাই কি আমার নিয়ন্ত্রক? না আমি তোমাদের?”

এই বৈপরীত্য আর কাকতালীয় নয়। এটা মানুষ নামের জীবের লোভ, অবিচার, এবং সীমাহীন আত্মমোহের ফল। মানুষের মধ্যে এখন স্বাভাবিক জীবনযাত্রার চেয়ে প্রতিযোগিতা, প্রতিহিংসা, এবং একে অন্যকে ঘায়েল করার কৌশলই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে কারণে আজ মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠছে—“মানুষ কি সত্যিই আশরাফুল মাখলুকাত?”

কখনো কখনো মনে হয়, সৃষ্টিকর্তাও হয়তো ভাবছেন—“আমি কেন এমন একটি জাতিকে সৃষ্টি করলাম, যারা ক্ষমতা আর লাভের জন্য সবকিছু ভুলে যেতে পারে?”( নাউজুবিল্লাহ—হে আল্লাহ, আমাদের ক্ষমা করো।)

সমস্যা হলো—আমরা নিজেদের ভুল বুঝি, তবু স্বীকার করি না। কাকে ঠকিয়ে কে বড় হবে, কাকে দমন করে কে ক্ষমতা পাবে, এসব হিসাবের মাঝেই হারিয়ে যাচ্ছে সহানুভূতি, মায়া, ভালোবাসা। সত্য বললে কেউ পাশে দাঁড়ায় না, অথচ মিথ্যার রঙে রাঙানো কুকর্মীরা হয়ে ওঠে নায়ক।

তাই বলা যায়, প্রকৃতি আর সমাজ—দুটোরই ভারসাম্য আজ ভেঙে পড়েছে। একটি নষ্ট হলে অন্যটি তার প্রতিক্রিয়া দেয়। আর যদি আমরা এখনই না থামি, না বদলাই—তবে হয়তো একদিন প্রকৃতিই আমাদের চূড়ান্ত জবাব দিয়ে দেবে, এমনভাবে, যেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব।

মুখোশধারীদের সমাজে অতি-ভদ্রতা একটি পাপ


এই সমাজ
, সমাজের মানুষগুলো, জীবন ও পৃথিবী- সবই এক গভীর বৈচিত্র্যে পূর্ণ। এখানে কেউ চেহারায় নিষ্পাপ, কিন্তু অন্তরে ধূর্ত; কেউ মুখে নীতিকথা বলে, কিন্তু পেছনে কুৎসার বীজ বপন করে। মানুষ চেনা সত্যিই দুঃসাধ্য, কারণ মানুষ চেনা যায় না চোখের দৃষ্টিতে, চেনা যায় সময়ের আয়নায়। সম্পর্ক, সৌজন্যতা কিংবা উপকার এসবের উপর ভিত্তি করে কাউকে চেনা প্রায়শই বিভ্রান্তিকর। কারণ মানুষের প্রকৃত চরিত্র, তার অন্তর্নিহিত রূপ, ধীরে ধীরে সময়ের পরীক্ষায় প্রকাশ পায়। এ যেন এক দীর্ঘ নাট্যচিত্র, যেখানে কেউ অভিনয়ে পটু, কেউ শুধু নির্বাক দর্শক।

আজকাল মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো তাদের উপকারীর প্রতি অসহিষ্ণুতা। অতীতে তুমি যার উপকার করেছো, একদিন তাকেই হয়তো দেখবে তোমার বিপদ ডেকে আনছে। যার জন্য নিজে কিছু করেনি, তার উপকারও সে নিতে চায়। কিন্তু যখন উপকারের উপায় শেষ হয়ে যায়, তখন সেই মানুষটিই উপকারকারীর ক্ষতির চিন্তায় মত্ত হয়। উপকারের বিনিময়ে কৃতজ্ঞতা নয়, বরং অসূয়া হয়ে ওঠে তার প্রতিক্রিয়া। কেন? কৃতজ্ঞ হওয়ার বদলে সে কেন হয়ে ওঠে হিংস্র ও প্রতিহিংসাপরায়ণ? কারণ মানুষ যতক্ষণ সুবিধা পায়, ততক্ষণ সে শান্ত থাকে। কিন্তু যখন সে বুঝে, তার চাওয়া পূরণ আর সম্ভব নয়, তখন তার ভিতর ভালোবাসা নয় বরং বিদ্বেষ জন্মাতে শুরু করে। উপকার পেতে পেতে একসময় সে ভুলে যায়, কৃতজ্ঞতা কাকে বলে। বরং তাকে ঘিরে তৈরি হয় এক ধরনের অহংবোধ, সে ভাবে, "আমিই এই উপকারের যোগ্য ছিলাম, এ তো আমার প্রাপ্য।"

বিশেষ করে যদি তুমি ভদ্র, শান্ত, সহনশীল এবং সহজ-সরল হয়ে থাকো, তবে তোমার বিপদ আরও বাড়ে। কারণ সমাজের এক শ্রেণির মানুষ দুর্বলতার সুযোগ নিতে সদা প্রস্তুত। তারা জানে, তুমি প্রতিবাদ করবে না, চিৎকার করবে না, সুতরাং তোমার পিঠেই সবচেয়ে বেশি আঘাত করা যায়। এরা মুখে মিষ্টি, অন্তরে বিষাক্ত। এদের জন্য ভদ্রতা যেন নিজের বিপদের দাওয়াতপত্র।

এক শ্রেণির মানুষ আছে, যাদের সমাজে বলা হয় “মেধাবী”। এই বিশেষণ তাদের আত্মতুষ্টির এমন এক চূড়ায় পৌঁছে দেয়, যেখানে তারা ভুলে যায় যে, সত্যিকারের জ্ঞান বিনয়ের জন্ম দেয়, অহংকারের নয়। সমাজের অন্ধ প্রশংসা যখন একটানা কারো প্রতি বর্ষিত হয়, তখন তার ভেতরে জন্ম নেয় এক প্রকার আত্মম্ভরিতা। সে তখন নিজেকে অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ ভাবতে শুরু করে, ভুলে যায় নিজের বাস্তব পরিচয়, তার পারিবারিক ভিত্তি, শিক্ষাগত যোগ্যতা, সামাজিক অবস্থান আদৌ কতটা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারে না, যোগ্যতা শুধু কাগজে-কলমে নয়, মানসিকতা, মানবিকতা, সততা সবকিছু মিলেই তা পূর্ণতা পায়।

তাদের কাছে নিজেকে বড় দেখানোর সহজ উপায় হলো অন্যদের ছোট করা। বিশেষ করে, যারা প্রকৃত অর্থে মেধাবী, সৎ এবং নির্লোভ, তাদের প্রতি আক্রমণ করাই এদের প্রিয় কাজ। মিথ্যা কথা, চরিত্রহনন, গুজব রটানো, এমনকি দুঃসময়ে ছুরি মেরে দেওয়া, এগুলো যেন তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়। কারণ যদি তারা সেই প্রকৃত যোগ্যদের সম্মান দেয়, তবে নিজেদের কৃত্রিম শ্রেষ্ঠত্ব বজায় থাকবে কীভাবে? সে ভাবে, অন্যকে মাটিতে নামিয়ে আনলেই সে আকাশে উঠবে।

এই চতুর, আত্মম্ভরী, কথিত মেধাবী মানুষগুলো যখন সমাজের নিয়ন্ত্রণ নেয়, তখন তাদের চারপাশে জড়ো হতে থাকে সুবিধাবাদী গোষ্ঠী।এই সুবিধাবাদীরাই তাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, গড়ে ওঠে এক সামাজিক অসুস্থতা। তারা চায় বিশৃঙ্খলা, কারণ বিশৃঙ্খল সমাজেই সবচাইতে বেশি সুবিধা পাওয়া যায়। সত্য, ন্যায়, মেধা, মূল্যবোধ- সব কিছু তখন হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়। এই গোষ্ঠী নিজেদের প্রয়োজনেই কুৎসাকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে, তাদের দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে, আর সমাজে একটি পঁচনশীল কাঠামোর জন্ম দেয়।

যদি এইসব অন্যায়ের সামনে তুমি নীরব থাকো, যদি তুমি ভাবো ভদ্রভাবে এড়িয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে, তবে তুমি ধ্বংসকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছো। কারণ এরা নীরবতাকে ভয় পায় না, বরং প্রশ্রয় মনে করে। তারা তখন নিজের সীমা ভুলে নিজেকে অপ্রতিরোধ্য ভাবতে শুরু করে।

এই মুখোশধারীরা মানবিকতা বোঝে না, বিবেক বোঝে না, কৃতজ্ঞতা বোঝে না। এদের কাছে সৌজন্য এক ধরনের বোকামি, ভদ্রতা একধরনের দুর্বলতা, আর নৈতিকতা একধরনের আবেগপ্রবণ বেহায়াপনা। তাদের সামনে তোমাকে তাদের ভাষাতেই কথা বলতে হবে, বলতে হবে সত্যের ভাষায়, যুক্তির ভাষায়, প্রয়োজনে কঠোরতার ভাষায়। ভদ্রতা নয়, দৃঢ়তা হোক তোমার ঢাল। ক্ষমা নয়, বিচার হোক তোমার শপথ। কারণ, একমাত্র প্রতিবাদীরাই ইতিহাস গড়তে পারে আর নীরবরা হয় কেবল নির্যাতনের পাতার একটি নাম। 

এ প্রসঙ্গে বলবো- 

"ভদ্র হওয়া ভালো , নীরব থাকা উত্তম। কিন্তু এটাও ধ্রুব সত্য- ভদ্রতা যদি সত্যকে চাপা দেয়, তবে সেটি কাপুরুষতা। তাই সত্যকে চিৎকার করে জানাও এবং এটাই ভদ্রতার প্রকৃতরুপ।"