বৃহস্পতিবার, আগস্ট ০৭, ২০১৪

কামড়ে খামচে মেয়েদের 'আদর' করছে পুরুষেরা


যে সমাজে পুরুষ নারীর কর্তা, নারীর প্রভু, নারীর নিয়ন্ত্রক, নারীর নিয়ন্তা, সেই সমাজে নারীর সঙ্গে পুরুষের যা- হোক, প্রেম হতে পারে না ননীটা ছানাটা খেয়ে বড় হওয়া পুরুষ এঁটোটা কাঁটাটা খেয়ে বড় হওয়া নারীর সঙ্গে বড়জোর খুনসুটি করতে পারে, প্রেম নয় নারীর প্রতি পুরুষের করুণা এবং পুরুষের প্রতি নারীর শ্রদ্ধাকে সমাজে প্রেম বলে বিবেচনা করা হয় এই প্রেম হৃদয় এবং শরীর দু'টোকেই ঢেলে দেয় তথাকথিত যোগ্য বা অযোগ্য পাত্রে নারীর হৃদয় নিয়ে পুরুষ যা করে, তা অনেকেরই জানা কিন্তু শরীর নিয়ে কী করে? নারীর প্রতি যেহেতু পুরুষের কোনও শ্রদ্ধা নেই, নারীর শরীরের প্রতিও নেই নারীর শরীর পাওয়া পুরুষের জন্য বাঘের হরিণ পাওয়ার মতো হরিণের জন্য কোনও শ্রদ্ধাবোধ বাঘের নেই ছিঁড়ে খেতে বাঘের কোনও গ্লানি নেই খিদে পেয়েছে, শিকার করেছে, খেয়েছে খেয়ে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে নিজের টেরিটরিতে ফিরে যাবে, ফের খিদে পেলে ঝাঁপিয়ে পড়বে নতুন কোনও হরিণ পেতে, না পেলে মোষ বা মানুষ    

পুরুষেরা কটকটি কামড়ানোর মতো নারীর ঠোঁট কামড়ালো, এর নাম দিয়ে দিল চুম্বন যে নারী এভাবেই চুম্বনের অভিজ্ঞতা অর্জন করে, সে তো চুম্বন বলতে তা- বোঝে, ধারালো দাঁতের কামড়, ঠোঁট ফুলে যাওয়া, ছিঁড়ে যাওয়া, রক্তাক্ত হওয়া ঠোঁট কামড়ানোর পর পুরুষেরা নারীর বুক নিয়ে পড়ে দলে পিষে সর্বনাশ করে ক্ষণে ক্ষণে খামচে ধরে নখে ছেঁড়ে, দাঁতে কাটে নারীকে ভালোবাসলে, নারীর শরীরকেও ভালোবাসতে পারতো পুরুষ, ভালোবাসলে আঙুল নরম হত, দাঁত নখ লুকিয়ে থাকতো পুরুষ নিজের আনন্দ ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না নারীর কিসে ভালো লাগবে, কিসে লাগবে না, তা জানার চেষ্টা তারা কোনওদিন করেনি জানলেও গুরুত্ব দেয়নি, নারীর সুখ অসুখের তোয়াক্কা পুরুষ করেনি কখনও  
নারীও অনেক সময় জানে না, কী করলে তাদের ভালো লাগবে, কী করলে শরীরে সুখ হবে নারীকে যেভাবে যা বোঝায় পুরুষ, নারী সেভাবেই বোঝে তার কি আর আলাদা করে নিজের মাথা এবং হৃদয় খাটিয়ে কিছু বোঝার ক্ষমতা আছে? নেই শরীরের সম্পর্কে পুরুষ হল 'দ্য মাস্টার, মেগালোম্যানিয়াক ম্যাচো', আর নারী তার ক্রীড়নক পুরুষ সুপিরিয়র, নারী ইনফিরিয়র পুরুষ অ্যাকটিভ নারী প্যাসিভ  
নারী প্যাসিভ না হলে পুরুষের মুশকিল হয় হরিণ নড়েচড়ে উঠলে বাঘের ভক্ষণে যেমন মুশকিল হয়, তেমন জগতে পুরুষই রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, ধর্মে, অধর্মে, সমাজে, সংসারে, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সংস্কৃতিতে মহান মস্তান হয়ে বসে আছে এই নীতি রীতিগুলো পুরুষময় করে রাখার জন্য পুরুষেরা ভয়ংকর রকম অ্যাকটিভ এই অ্যাকটিভ পুরুষ বিছানায় গিয়ে নারী নামক ভোগের বস্তুটিকে কী করে অ্যালাউ করবে অ্যাকটিভ হওয়ার? অসম্ভব ইগোর ঘরে আগুন জ্বলবে পুরুষ ততটুকুই নড়তে দেবে নারীকে, যতটা নড়ন হলে পুরুষের গায়ে পুলক লাগে বাৎসায়নমশাই চোষট্টি কলার কথা জোর গলায় বলে গেলেও এক মিশনারি কলাতেই তৃপ্ত বাঙালিবাবুরা, বাকি তেষট্টি কলার পেছনে সময় খরচ না করে নারীকে প্যাসিভ বা পুঁইশাক বানিয়ে রাখার কলা কৌশল ভালো রপ্ত করেছেন 
পুরুষের রসবোধ কম কম বলেই নারীর রসবোধ নিয়ে আতংকিত তারা রসক্ষরণ না হলে যাত্রা মসৃণ হয় না, জানার পরও রসক্ষরণের রাস্তায় পুরুষের যেতে বড় আপত্তি বা আলসেমি পুরুষ প্রস্তুত সুতরাং সব্বাইকে প্রস্তুত হতে হবে ঘোড়া প্রস্তুত, লাগাম প্রস্তুত অর্ডার অর্ডার এক তুড়িতে পুরুষ গ্রহণে প্রস্তুত হও নারী তানাহলে তুমি আর নারী কীসের? তুমি আর সেবিকা কীসের? আনন্দদায়িনী, মনোরঞ্জনী কীসের? পুরুষের সুখশান্তিস্বস্তির জন্য আত্দাহুতি দিতে নারী সর্বত্র এক পায়ে খাড়া  
শীর্ষসুখ জানে নারী? 'জন নারী জানে? নারী জানে জগতের যত সুখ, সবই পুরুষের জন্য নারীর যে একেবারে সুখ নেই তা নয়, নারীর সুখ পুরুষকে সুখ দিয়ে নারীর অন্য সুখ থাকতে নেই আনন্দ বলতে কিছু অনুভব করতে নেই পুরুষ এভাবেই যুগ যুগ ধরে নারীর মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিয়েছে ত্যাগী হওয়ার মন্ত্র নারীর ত্যাগই পুরুষের সবচেয়ে বেশি প্রার্থনীয় নারী তার নিজস্বতা, তার পৃথক অস্তিত্ব, তার সাধ, তার সুখ সবই সানন্দে ত্যাগ করবে আর এই ত্যাগকেই পুরুষ তাড়িয়ে তাড়িয়ে ভোগ করবে নারীর ত্যাগএর মতো এত সুস্বাদু আর উপাদেয় জগতে আর কোনও খাদ্য নেই  
নারীরা যদি সমকামী হত, বেঁচে যেত অসমকামী হওয়ার অসুবিধে হল, অনাদর, অবহেলা, অপমান, অসন্তোষকে একরকম সঙ্গী করেই জীবন কাটাতে বাধ্য হতে হয় পুরুষ পালকের মতো করে স্পর্শ করবে নারীর সারা শরীরে, নারী একটু একটু করে কুঁড়ি যেমন ফুল হয়ে ফোটে, তেমন ফুটবে বাঘিনীর মতো কামার্ত চোখে তাকাবে, হরিণের মতো কাতর চোখে নয় পুরুষের নিঃশ্বাসে স্পর্শে, ঘামে গন্ধে, কামে, কাঙ্ক্ষায় উপচে উঠবে তীব্র প্রেম ওঠে কি? না দৈত্যের মতো উঠে আসে ধর্ষণেচ্ছা মেগালোমেনিয়া মাচিসমো নারীকে পিষে নিংড়ে ছোবড়া করে দেওয়ার পুরুষিক সুখ   
জগত পুরুষের ভারতবর্ষ তো আরও বেশি পুরুষের পুরুষ কামনা করবে নারীকে, পুরুষের যখন খুশি, তখন নারীর কামনা বাসনা থাকতে নেই থাকলেও প্রকাশ করতে নেই নারীর শরীর জাগতে নেই, জাগলে ঘুম পাড়িয়ে রাখাই মঙ্গল নারীর এগিয়ে আসতে নেই চুমু খেতে নেই যৌনতায় নারী প্রধান ভূমিকা নিতে পারে না নারী যৌনপ্রভু নয়, 'যৌনদাসী' এই চরিত্রটি সযতনে নারীকে উপহার দিয়েছে পুরুষ যৌনতায় নারী যদি সঙ্গীর ভূমিকাও নেয়, তবুও পুরুষের পিলে চমকে ওঠে, শিশ্ন শিথিল হয় যতক্ষণ না নারী যৌনদাসীর ভূমিকায় নামছে, ততক্ষণ অবধি পুরুষের উত্থান অনিশ্চিত    
নারী যৌনতৃষ্ণায় কাতরালে সে নারী মন্দ, পুরুষ যৌনতৃষ্ণায় কাতরালে পুরুষ বীর্যবান, শৌর্যবান এই বৈষম্য নিয়ে সত্যিকার সুস্থ কোনও যৌনসম্পর্ক কি হতে পারে নারী পুরুষে? না পারে না ঘরে ঘরে নারী-পুরুষ দুজন মিলে যে যৌনসম্পর্ক করছে, তাকে কথ্য বাংলায় বলা হয় 'পুরুষ নারীকে করছে' মুখের ভাষা থেকেই কিন্তু বেরিয়ে আসে বৈষম্যের বীভৎস চিত্র 'ওরা করছে' বদলে ' করছে' একজন কাজ করছে, আরেকজন বসে আছে, ব্যাপারটা এরকম যৌনতায় নারীর কোনও ভূমিকা নেই, থাকতে নেই- তা সর্বজনমান্য রায়  
উত্থানরহিতে জগত ভর্তি অথচ দেখলে বোঝার জো নেই কারও লজ্জা নেই, মাথা হেঁট নেই, দুশ্চিন্তা নেই উত্থানরহিতদের মস্তক কিন্তু উত্থিত থাকে আর যে নারীরা উত্থানরহিতদের শিকার, তারাই বরং মাথা নত করে দিন কাটায় দুঃসহ রাত্তির কাটায় নারী যৌনতৃপ্তি পাক, এটা আন্তরিকভাবে খুব বেশি উত্থানরহিত কি চায়? চাইলে চেষ্টা থাকতো নিজেকে সংশোধনের যৌনতার নামে দিনের পর দিন নারীর ওপর অত্যাচার চালাতো না    
পুরুষ যেদিন বিশ্বাস করবে নারীর সমঅধিকারে, পুরুষ যেদিন নারীর স্বাধীনতাকে শর্তহীন সম্মান জানিয়ে ধন্য হবে, পুরুষ যেদিন তাদের কুৎসিত পৌরুষ বিসর্জন দিয়ে, তাবৎ পুরুষিক নৃশংসতা-কদর্যতা ত্যাগ করে মানুষ হবে, মানবিক হবে, নারীকে স্পর্শ করবে প্রেমে, যে প্রেমে অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে থাকে শ্রদ্ধা; সেদিনই হবে সত্যিকার নারী পুরুষের যৌনসম্পর্ক তার আগ অবধি ঘটনা ওই একই, একজন ভোগ করে, আরেকজন ভোগে 
'নারী স্বাধীনতা' অর্থ 'যৌন স্বাধীনতা'- এরকম মন্তব্য অনেকে করে বিদ্রূপ করে বলা কথা কথা কিন্তু সত্য যৌন স্বাধীনতা ছাড়া নারী কখনও সত্যিকার স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে না, পারেনি যে নারীর শরীর তার নিজের অধিকারের বাইরে চলে যায়, সেই নারী কোনও অর্থেই 'স্বাধীন নারী' নয় শিক্ষা পেলেও, স্বনির্ভর হলেও, এই নারীবিদ্বেষী সমাজে নারীরা 'যৌনদাসিত্ব' থেকে মুক্তি পেতে পারে না এই দাসিত্ব থেকে মুক্ত হয়ে, এই বন্দিত্ব থেকে বেরিয়ে নারী যদি যৌন স্বাধীনতা পুরোপুরি ভোগ করতে পারে, তবেই সে নারীকে 'স্বাধীন' বলে মানবো আমি যৌন স্বাধীনতা মানে পুরুষ পেলেই শুয়ে পড়া নয়, পুরুষের সঙ্গে না শোয়ার নামও যৌন স্বাধীনতা চারদিকে ধর্ষকের ভিড়, সময় ধর্ষক-ধ্বজভঙ্গদের আহ্বানে আদেশে সাড়া না দেওয়ার জন্য যে যৌন স্বাধীনতা, তা থাকা প্রতিটি নারীর প্রয়োজন ঠোঁট কামড়ে, স্তন খামচে যে পুরুষেরা পৌরুষ ফলাতে চায়, তারা যত যা- হোক না কেন, তাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার যৌন স্বাধীনতা না পেলে মুক্তি নেই নারীর যে পুরুষেরা কেবল নিজের যৌনসুখ নিয়ে মগ্ন, নারীর যৌনসুখ নিয়ে ভাবা যাদের কম্ম নয়, সেই পুরুষদের সবলে অস্বীকার করার যৌন-স্বাধীনতা যে করেই হোক অর্জন করুক নারী   
লেখক : তসলিমা নাসরিন