সোমবার, জুন ৩০, ২০১৪

ফুটবলের দেবতা নাকি ব্রাজিলীয়! -সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়

অনেকেই বলেন, ফুটবলের দেবতা নাকি ব্রাজিলীয়! শনিবার রাতে ব্রাজিল-চিলি ম্যাচে বারবারই মনে হল, দেবতা যথার্থই ব্রাজিলের জার্সি গায়ে নেমেছিলেন৷ 
আসলে যে কোনও খেলাতেই যাবতীয় পরিশ্রম, পরিকল্পনা বা প্রচেষ্টার পরও একটা ব্যাপার হাতে থেকে যায়৷ চান্স ফ্যাক্টর৷ যাকে চলতি কথায় ভাগ্য বলা হয়৷ যেটা ব্রাজিলের সঙ্গে ছিল৷ না হলে, ১১৯ মিনিটের মাথায় চিলির ফরোয়ার্ডের শট বারে লেগে ফেরে না৷ যদি এক সেণ্টিমিটার নিচেও বলটা থাকত, তা হলে এবারের বিশ্বকাপে ব্রাজিলের অভিযানের ওখানেই ইতি হয়ে যেত৷ 
কিন্ত্ত, বাস্তবটা হল চিলি ওই একবার নয়, টাইব্রেকারেও আরেকবার পোস্টে বল লাগাল৷ এবং বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিল৷ আর ব্রাজিল গোটা ম্যাচে নজর না কেড়েও শেষ পর্যন্ত টুর্নামেণ্টে ভেসে রইল৷ 
যে ঝলমলে খেলার জন্য ব্রাজিল ফুটবলের ফ্যান দুনিয়া জুড়ে, এই ব্রাজিল দল অবশ্যই সেটা এখনও পর্যন্ত দেখাতে পারেনি৷ নেমারের মধ্যে বিশাল প্রতিভা আছে, নিঃসন্দেহে৷ কিন্ত্ত, বাকি দলটা? যেদিন নেমার মার্কিংয়ে আটকে যাবে, কিংবা তেমন ছন্দে থাকবে না, সেদিন বাকি দলটা প্রতিপক্ষর উপর কোনও প্রভাবই ফেলতে পারবে না৷ অন্তত চিলির বিরু‌দ্ধে ম্যাচে সেটাই বারবার করে চোখে পড়ল৷ 
খুব মনে পড়ছে, ১৯৯০-এর বিশ্বকাপে মারাদোনার কথা৷ প্রতি ম্যাচেই ওকে বোতলবন্দি করে রাখার পরিকল্পনা ছিল প্রতিপক্ষ রক্ষণের৷ সঙ্গে ছিল কড়া ট্যাকল, পা লক্ষ্য করে বুটের আঘাত ইত্যাদি৷ কিন্ত্ত, তার মধ্যেও একটা বা দু'টো ম্যাজিক মুহূর্তে গোটা রক্ষণ টপকে বল বাড়িয়ে দিয়েছিল, যার থেকে ক্যানিজিয়া বা বুরুচাগা গোল করে ম্যাচ বের করেছিল৷ নেমারের বয়স অনেক কম৷ আশা করব, আরেকটা পরিপক্ক হয়ে ভবিষ্যতে ওই স্তরে নিজেকে নিয়ে যেতে পারবে৷ কিন্তু শুধুমাত্র চিলি ম্যাচ দিয়ে যদি বিচার করতে হয়, তা হলে বলতে হবে এখনও পর্যন্ত ওই গুণটা রপ্ত করতে পারেনি৷ অর্থাত্, খারাপ দিনেও একটা বা দু'টো ম্যাচ জেতানোর মুহূর্ত বের করা৷ 
নেমারের একার দোষ অবশ্য নয়৷ ওর সতীর্থরাও সেই মাপের নয়৷ যেদিন নেমার আটকে যাবে, সেদিন কী হবে সেই নিয়ে কোনও ভাবনাচিন্তা দলের বা কোচের আছে বলে মনে হয়নি৷ 
দ্বিতীয় এমন কাউকে চোখে পড়েনি, যে ওইরকম দিনে ম্যাচ বের করে নিয়ে যেতে পারবে৷ এই ব্রাজিলকে কখনওই স্পেশাল বলা যাবে না৷ ফ্রেড বা তার বদলি জো-কে নিতান্তই সাধারণ বলে মনে হয়েছে৷ ফলে ব্রাজিল এমন একটা দলে পরিণত হতে চলেছে, যাদের নেমার ছাড়া দ্বিতীয় কোনও স্ট্রাইকার নেই৷ বিপজ্জনক ব্যাপার হল, এটা বাকি দলগুলো ভালই জেনে গিয়েছে৷ ফলে ওদের সবারই টার্গেট এবার থেকে হবে নেমার৷ ফ্রেড বা জো-কে এই জায়গা থেকে গোলের রাস্তা খুঁজে বের করতেই হবে৷ কিংবা হাল্ককে৷ যাকে দেখে মনে হল প্রচুর পরিশ্রম করছে৷ কিন্ত্ত, প্রতিপক্ষ রক্ষণে সেই দাঁত ফোটানোর ব্যাপার ওর মধ্যেও নেই৷ 
অনেকটা দু'জন ভাল ওপেনার ছাড়া একটা ক্রিকেট দলের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে এই ব্রাজিলের৷ যদি ভাল ওপেনিং জুটি না থাকে, তা হলে ইনিংসের ভিত্তিটাই তৈরি হয় না, যার উপর নির্ভর করে একটা দল ভাল রান করতে পারে৷ সেই হিসাবে ক্রিকেট দলে দুই ওপেনারের যা ভূমিকা, ফুটবল দলে দুই স্ট্রাইকারেরও তাই৷ প্রতিপক্ষ তোমায় যতই কঠিন মার্কিংয়ে রাখুক না কেন, একটা হাফ চান্স পেলেই তুমি গোল করে দেবে৷ স্ট্রাইকার এই স্তরের হওয়া দরকার৷ তা হলে গোটা দলই বাড়তি আত্মবিশ্বাস পেয়ে যায়৷ এই বিশ্বাসটা থাকে যে, যদি গোল খেয়েও যায়, তা হলেও ঠিক গোল করে দেবে৷ 
এতটা হতাশা হচেছ কারণ, এই ব্রাজিল দলকে প্রচুর মিস পাস করতে দেখা গেল৷ যেটা আগে দেখা যায়নি৷ এমনকী, বেশিক্ষণ বল ধরেও রাখতে পারছে না৷ যাতে প্রতিপক্ষকে ইচছামতো খেলানো যায়৷ এমনটা তো আগে হয়নি৷ নিজের প্রতি বিশ্বাস না থাকলেই এটা সাধারণত হয়৷ এই ব্রাজিল তারকাদের কি সেটা নেই? মনে হয় না৷ এরাই তো ইউরোপের সেরা দলগুলোয় খেলে৷ তা হলে? হতে পারে, ঘরের মাঠে প্রত্যাশার মাত্রাতিরিক্ত চাপে ওরাও পরপর ভুল করে ফেলছে৷ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বল রিলিজ করে দিচেছ৷ যার ফলে বলের দখলও হারাচেছ৷ 
এর পরও ব্রাজিল কোয়ার্টার ফাইনালে গেল৷ ওদের গোলকিপার সিজারকে ধন্যবাদ দিতেই হবে, টাইব্রেকারে দু'টো অসাধারণ সেভ করার জন্য৷ ওই কারণেই টাইব্রেকারে চিলির উপর সারাক্ষণ চাপ থেকে গেল৷ 
এর পরও একটা কথা থেকে যায়৷ সেটা হল, বড় দলগুলি নাকি বড় জায়গায় আসল খেলা বের করে আনে৷ খেলোয়াড়রাও সেরাটা দেয়৷ আমি ব্রাজিল ফুটবলের ফ্যান৷ আশা করব, পরের ম্যাচগুলোতে ওরা সেই সাম্বা ফুটবলটা বের করে আনবে, যা দেখার জন্য সবাই অপেক্ষায়৷