শুক্রবার, জুন ২৭, ২০১৪

দুই তারকার পতন

একদিনে দুই তারকার পতন। একজন দলসহ বিদায়, আরেকজন নিজে বিদায়। একজন মাঠে ছিলেন ফ্লপ আরেকজন ছিলেন দুর্দান্ত। একজন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো অপরজন লুইস সুয়ারেজ। এবারের ফিফা ব্যালন ডি’অর বিজয়ী রোনালদোর বিশ্বকাপ স্বপ্ন শেষ তার দলের বিদায়ে। আর সুয়ারেজের স্বপ্নভঙ্গ কামড়ে। সুস্থ না থাকায় প্রথম খেলায় খেলতে পারেনি। সে খেলায় তার দল হেরে যায় কোস্টারিকার কাছে। পরের খেলায় ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দুই গোল দিয়ে নায়ক হয়ে গিয়েছিলেন ইংলিশ লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা ও গত বিশ্বকাপের সেরা উদীয়মান তারকা সুয়ারেজ। কিন্তু  ইতালির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় খেলার শেষ মুহুর্তে জন্ম দেন এক ঘৃণ্য অধ্যায়ের। বল দখলে ব্যর্থ হয়ে কামড় বসিয়ে দেন ইতালির ডিফেন্ডার কিয়েলিনির কাঁধে। আর তাতেই নেমে আসে শাস্তির খড়গ। গতকাল ফিফার ডিসিপ্লিনারি কমিটি তাকে ৯টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ আর চার মাস ফুটবলের সব কর্মকান্ড থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। জরিমানাও করে ১ লাখ সুইস ফঁ্রা। 
গতকাল গ্রুপ এফ জার্মানি-যুক্তরাষ্ট্র খেলার আগে গুঞ্জন ছিল পাতানো খেলার। দুই দলের কোচই জার্মান এবং সহকর্মীও ছিলেন। আর খেলাটি ড্র হলে দু’দলই দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত হয়ে যাবে। কিন্তু সে জল্পনা উড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জালে এক গোল দিয়ে দেয় জার্মানি। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি পর্তুগাল-ঘানা কারও। ঘানা জিতলে একটা সম্ভাবনা ছিল তাদের। এই গ্রুপে ঘানাই কেবল জার্মানদের রুখে দিয়েছিল। কিন্তু ঘানা হেরে গেছে আত্মঘাতি আর রোনালদোর গোলে। ফলে তারা স্থান পায় সবার নিচে। কিন্তু পর্তুগাল জয় নিয়ে মাঠ ছাড়লেও লাভ হয়নি। জার্মানির বিপক্ষে প্রথম খেলাতে যে চার গোল হজম করে পর্তুগাল তারই খেসারত দিলো তারা। যুক্তরাষ্ট্র হেরেও দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে গেছে কম গোল খাওয়ার সুবাদে। চলতি আসরের কেবল গোল ব্যবধানে বাদ পড়লো একটি দল। জি গ্রুপে জার্মানি চ্যাম্পিয়ন আর যুক্তরাষ্ট্র রানার্সআপ।  
গতমাসেই ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের রিয়াল মাদ্রিদকে রেকর্ড সংখ্যক গোল করে শিরোপা জিতিয়েছেন রোনালদো। সবার প্রত্যাশা ছিল লুইস ফিগোর মতো তিনিও দলকে অনেকটা এগিয়ে নিতে পারবেন একাই। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। দুই খেলায় কোন গোলই করতে পারলেন না। যখন গোল পেলেন তখন সব শেষ। এবারের বিশ্বকাপের তিন তারকার এক তারকা ছিলেন তিনি। একদিকে বার্সেলোনার মেসি-নেইমার অন্যদিকে রিয়ালের রোনালদো। বার্সেলোনার দেশ স্পেন বিদায় নিলেও তাদের দুই প্রাণভোমরা দুর্দান্ত। আর্জেন্টিনার হয়ে মেসি আর ব্রাজিলের হয়ে নেইমার চলেছেন সমানতালে। দু’জনই এখন চার গোল করে এক কাতারে। তাদের পাশে এসে কাল দাঁড়িয়েছেন বায়ার্ন মিউনিখের তারকা টমাস মুলার। রোনালদোর আলো যেন এখন তার ওপর। প্রথম খেলাতেই পর্তুগালের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করে গত আসরের গোল্ডেনবুটজয়ী মুলার জানান দেন যে, আমি এবারও আছি। গতকাল রেসিফে তার দেয়া গোলেই যুক্তরাষ্ট্রকে পরাস্ত করে জার্মানি। খেলার ৫৫ মিনিটে গোলটি করেন তিনি।  
পর্তুগাল বিদায় নিলেও দুঃখ পেতে পারে ঘানাও। ম্যাচটা তারাও জিততে পারতো। কিন্তু খেলার আগেই তাদের দলে দেখা দেয় বিদ্রোহ। প্রাপ্ত অর্থ না পাওয়ার কারণে না খেলার হুমকি ছিল ঘানার খেলোয়াড়দের। আর তা মেটাতে তাদের দেশের প্রেসিডেন্ট উড়ে আসেন অর্থ নিয়ে। খেলোয়াড়দের বিদ্রোহ আপাতত মেটান। কিন্তু এর জেরে তারা দলের দুই নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় সালে মুনতারি ও বোয়েটাংকে করে বহিস্কার। তারপরও তারা শুরু করেছিল সমানতালে। কিন্তু খেলার ৩০ মিনিটের সময় জন বোয়ের আত্মঘাতি গোল তাদের পিছিয়ে দেয়। গোলমুখ থেকে বল ফিরিয়ে দিতে গিয়ে তা নিজেদর জালেই জড়িয়ে দেন তিনি। তাতেও দমেনি তারা। দ্বিতীয়ার্ধেও ১০ মিনিটে তাদের বর্ষিয়ান ডিফেন্ডার অধিনায়ক আসামোয়াহ জিয়ান চমৎকার গোল করে খেলায় সমতা ফেরান। এর ৫ মিনিট পর তার পাস থেকে আরেকটি সহজ গোলের সুযোগ নষ্ট করেন মাজিদ ওয়ারিস। সব আশা যখন শেষের পথে তখন খেলা শেষ হতে বাকি ১০ মিনিট। ঠিক সেই ঘানার গোল মুখে জটলা থেকে বল চলে আসে বঙের মাথায় দাঁড়ানো রোনালদোর পায়ে। তিনি প্রচ- শটে তা জালে জড়িযে দেন। দল এগিয়ে যায়। তবুও উল্লাস নেই কারও মধ্যে। জানা ছিল এ গোল যথেষ্ট নয় তাদের বিদায় রুখতে। শেষ বাঁশি বাজার পর জয়ী দলের চোখেও পানির ঢল। একে অপরকে সান্ত্বনার বানীও দিতে পারছিলেন না পর্তুগিজরা। নিজেদের উপনিবেশে খেলতে এসেও সফলতা না পাওয়ার বেদনাটা একটু বেশিই।   
ব্রাজিলের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই শহর রেসিফে গতকাল এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল খেলার আগে। সকাল থেকেই প্রচ- বৃষ্টি হয়। ফলে রাস্তাঘাটে তলিয়ে যায়। অনেক স্থানে পানি জমে প্রায় দু’ফুট। ফলে মানুষের চলাচলে যেমন বিঘ্ন সৃষ্টি হয় তেমনি জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের খেলোয়াড়রাও অনুশীলন করতে পরেনি। ভেজা মাঠেই খেলা শুরু হয়। খেলোয়াড়রা হালকা গা গরম করে নেয়। খেলা শুরু হয় স্থানীয় সময় ঠিক দুপুর ১টায়। তবে ব্রাসিলিয়ায় ছিল রোদ্রকরোজ্জ্বল আবহাওয়া যেখানে পর্তুগাল ও ঘানা অবতীর্ণ হয়। 
বিশ্বকাপ শেষ সুয়ারেজের
নায়ক থেকে খলনায়ক। ৯ ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা পেলেন উরুগুয়ে ফুটবলার লুইস সুয়ারেজ। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে ইতালি ডিফেন্ডার জর্জিও কিয়েলিনিকে কামড়ে দেয়ার দায়ে সুয়ারেজকে এ শাস্তি দিয়েছে আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা ফিফা’র ডিসিপ্লিনারি কমিটি। চলতি বিশ্বকাপে গ্রুপের শেষ ম্যাচে ইতালি ডিফেন্ডার কিয়েলিনিকে কামড়ে দেয়ার অভিযোগ ওঠে সুয়ারেজের বিরুদ্ধে। শুনানি শেষে সুয়ারেজকে এ শাস্তি শোনাল ফিফা। ফিফা’র বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শাস্তির বিষয়টি লুইস সুয়ারেজ ও উরুগুয়ে ফুটবল ফেডারেশনকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে গতকালই । ফুটবলার  সুয়ারেজের এ শাস্তি বলবৎ হচ্ছে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচ থেকে। দ্বিতীয় রাউন্ডে মহাদেশীয় প্রতিদ্বন্দ্বী কলম্বিয়াকে মোকাবিলায় নামছে দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে। গতকাল ফিফার দেয়া শাস্তিতে বলা হয়েছে, আগামী ৪ মাস ফুটবলীয় কোন কর্মকা-েও অংশ নিতে পারবেন না সুয়ারেজ। এ সময় বিশ্বের যে কোন প্রান্তের ফুটবল স্টেডিয়ামে প্রবেশে সুয়ারেজের জন্য থাকছে আলাদা নিষেধাজ্ঞা। এ ঘটনায় সুয়ারেজ জরিমানা গুনছেন ১,০০,০০০ সুইস মুদ্রা। পুরো ঘটনায় সুয়ারেজকে শাস্তি দেয়া হয়েছে ফিফা বিধির ভিন্ন ভিন্ন ধারায়। শাস্তি ঘোষণা শেষে ফিফা ডিসিপ্লিনারি কমিটির চেয়ারম্যান ক্লডিও সুলসার বলেন, কোন ফুটবল মাঠে এমন আচরণ সহ্য করার নয়, আর ফিফা বিশ্বকাপের মতো আসরেতো একবারেই না, যেখানে পুরো বিশ্বের কোটি কোটি দর্শকের দৃষ্টি থাকে ফুটবল তারকাদের দিকে। এবারের বিশ্বকাপে সুয়ারেজের গল্পটা ছিল রূপকথার মতো। আসর শুরুর ২৮ দিন আগে হাঁটুর অপারশেন নিয়ে এবারের বিশ্বকাপ অনিশ্চিত দেখাচ্ছিল এ উরুগুয়ে ফুটবলারের। গ্রুপে উরুগুয়ের প্রথম ম্যাচেও বেঞ্চেই দেখা গেছে সুয়ারেজকে। কিন্তু বাঁচামরার দ্বিতীয় ম্যাচে উরুগুয়ে দলের শুরুর একাদশেই জায়গা নেন সুয়ারেজ। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে  ওই ম্যাচে ২-১ গোলে জয় নিয়ে আশা জীবিত থাকে উরুগুয়ের। এতে উরুগুয়ের দুই গোলই করেন সুয়ারেজ। আর হার নিয়ে গ্রুপ থেকেই বিদায় নিশ্চিত হয় ১৯৬৬’র বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের। সেদিন পুরো ম্যাচে সুয়ারেজের নৈপুণ্য দেখে বৃটিশ মিডিয়া প্রশ্ন তোলে- সুয়ারেজ কি ডোপ নিয়ে খেলেছিলেন ওই ম্যাচ? আর সুয়ারেজের বিপক্ষে এমন প্রশ্ন ওঠার পেছনে দায় সুয়ারেজের ক্যারিয়ার আচরণও। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে বিতর্কিত কা-ে এর আগে দু’দফা ২০ ম্যাচে নিষেধাজ্ঞা পোহান সুয়ারেজ। এর প্রথমবার সুয়ারেজ শাস্তি পান প্রতিপক্ষ কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ফরাসি তারকা প্যাট্রিক এভরাকে বর্ণবাদী আচরণ দেখিয়ে। আর সুয়ারেজ পরেরবার শাস্তি পান প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় চেলসি তারকা ব্রানিস্লাভ ইভানোভিচের হাত কামড়ে দিয়ে। গত মওসুমের শুরুতে লিভারপুল কোচ ব্রেন্ডন রজার্সের সঙ্গে বনিবনার অভাব নিয়ে আলাদা খবর হচ্ছিলেন সুয়ারেজ। তবে শেষ পর্যন্ত লিভারপুলেই থেকে যান সুয়ারেজ আর বল পায়ে দেখান উড়ন্ত ফর্ম। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে সর্বোচ্চ ৩১ গোল নিয়ে সুয়ারেজ জিতে নেন ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুটও। উরুগুয়ের জার্সি গায়েও ৭৮ ম্যাচে সর্বাধিক ৪০ গোল লু্‌ইস সুয়ারেজের। সুয়ারেজের এই শাস্তির জন্য তার আইনজীবী এলিজান্দ্রো বালবি দোষ দিলেন ইংল্যান্ড ও ইতালিকে। সুয়ারেজের শাস্তির জন্য ইতালি ও ইংল্যান্ড প্রচ- চাপ দিয়েছিল বলে উরুগুয়ে রেডিও’র কাছে দাবি করেন এই আইনজীবী। তিনি বলেন, সুয়ারেজের শাস্তির পেছনে ইংল্যান্ড ও ইতালির চাপ কাজ করেছে। আমরা এটিকে খেলার মাঠের নিছক ঘটনা বলেই বিশ্বাস করি। ফিফার এ শাস্তির বিপরীতে আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে চাই আমরা।