শুক্রবার, জুন ২৭, ২০১৪

বন্দি হাসিনা ‘এসওএস’ পাঠান প্রণব মুখার্জির কাছে

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঢাকা পৌঁছেছেন। তার জন্য রয়েছে আমার কিছু পরামর্শ। বাংলাদেশকে অবধারিত বলে ধরে নেবেন না। তবে বাংলাদেশ ভারতের উপকারে আসতে পারে। দাদী-নানীসুলভ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতপন্থি মনে করা হলেও তিনি উলটো রূপও ধরতে পারেন, যে রূপ একবার দেখেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপায়ী। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন এনডিএ প্রথম দফায় ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাদেশ যে খারাপ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তার ফলে দ্বিতীয় দফা এনডিএ সরকারের সময়ে শঙ্কিত ছিল বাংলাদেশ। ২০১৪ সালের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে বিজেপি বাংলাদেশীদের উৎখাতের ঘোষণা দেয়। একই রকম আলটিমেটাম দেয়া হয়েছিল এর আগে ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে। তখন এক অপারেশন ব্যর্থ হয়েছিল। ওই সময় এ নিয়ে দু’দেশের সম্পর্ক তলানিতে এসে দাঁড়ায়। এনডিএ ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার অনেক পরে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সম্পর্ক ছিল জোড়াতালির। তখন কৌশলগত কারণে বাংলাদেশে সেনা সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকারের মন জয় করার চেষ্টা করে ইউপিএ। তখন শেখ হাসিনা ছিলেন বন্দি। তিনি সে সময় সেনাবাহিনীর হাত থেকে, জেল থেকে তাকে রক্ষা করতে একটি ‘এসওএস’ (সেভ আওয়ার সোল) পাঠান ভারতের প্রণব মুখার্জির কাছে। এরপর এ বিষয়টি কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইকে গুজরালের সঙ্গে আলোচনা করেন। তারা ‘সেভ হাসিনা’ বা হাসিনা রক্ষা অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা। এর পরপরই তিনি ভারতের প্রতিটি নিরাপত্তা বিষয়ক উদ্বেগ নিয়ে কাজ করেন। নির্ভরযোগ্য সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে এই লেখক বলছেন যে, ভারত তার প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও শেখ হাসিনা ভারতের কোন অনুরোধেই না বলেন নি। ইউপিএ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদ থেকে যখন ক্ষমতা থেকে সরে যায় তার আগে পি. চিদাম্বরম নিশ্চয়ই বাড়িয়ে বলেন নি। তিনি বলেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ও ভারত যেখানে ছিল আবার তারা তত ঘনিষ্ঠ হয়েছে। ইউপিএ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের সময়েই বাংলাদেশের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে সুষমা স্বরাজের। তাকে এবার দু’দেশকে আরও ঘনিষ্ঠ করতে সব বাধা দূর করতেই হবে। কিন্তু বিজেপি প্রথম দফায় যখন ক্ষমতায় ছিল তখন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে তিক্ত সম্পর্ক ছিল তা সুষমা স্বরাজের মনে রাখা উচিত। ২০০৪ সালে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে ৫০০০ স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ৩০০ রকেট, ১১ লাখ ৪০ হাজার বুলেট উদ্ধার করা হয়। এসব অস্ত্র চীন থেকে আমদানি করেছিল উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়া। তিনি বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে এসব অস্ত্র আমদানি করেন। অস্ত্রগুলো যাওয়ার কথা ছিল ভারতে। ভারতের জন্য সৌভাগ্য। তবে দুর্ভাগ্য পরেশ বড়ুয়া, তার বাংলাদেশী ও পাকিস্তানি সহযোগীদের। ওই চালানটি স্থানীয় পুলিশ আটক করে। ঢাকায় ঊর্ধ্বতন মহলের মাথা ঘামানোর আগে বিষয়টি নিয়ে পত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হয়। সুষমা স্বরাজ যদি অতীতের দিকে তাকান তাহলে তিনি দেখতে পাবেন ২০০১ সালের ১৮ই এপ্রিলের ঘটনা। ওই সময় বড়াইবাড়ী সীমান্তে বাংলাদেশ রাইফেলস (বর্তমানে বিজিবি) হত্যা করে ১৬ বিএসএফ সদস্যকে। তিনি এ ফুটেজটি দেখতে পারেন। নিহত বিএসএফ জওয়ানের মৃতদেহ গ্রামবাসী পা ও হাত বেঁধে বাঁশে করে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এমন ছবি প্রকাশ করে ঢাকা। উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো- তখন বাংলাদেশে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। বিএসএফ সদস্য হত্যার ঘটনায় যে উত্তেজনা ছিল তা নিরসনের জন্য অটল বিহারী বাজপায়ীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নয়া দিল্লি যেতে অস্বীকৃতি জানান শেখ হাসিনা। বিএসএফ সদস্য হত্যার প্রতিশোধ নিতে বাংলাদেশে আগ্রাসন চালানোরও জোর দাবি উঠেছিল। তখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানান, যাতে পরিস্থিতি শান্ত হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা যান নি। এনডিএ’র প্রথম দফার সরকার যখন ঘোষণা দেয় যে ভারতে ২ কোটি বাংলাদেশী অবৈধভাবে বসবাস করছে তখন দু’দেশের সম্পর্ক দ্রুত নিচে নেমে যায়। এ ঘোষণা দিয়েই ভারত চুপ করে থাকে নি। ভারত বিভিন্ন শহর থেকে কথিত বাংলাদেশীদের ধরে শুরু করে অপারেশন পুশব্যাক ও অপারেশন ফ্লাশ আউট। তারা বাংলাদেশীদের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়। কিন্তু ভারতের এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কারণ, বাংলাদেশী সীমান্ত রক্ষীরা ভারতের এ প্রচেষ্টাকে সফলভাবে ব্যর্থ করে দেয়। ভারত থেকে বাংলাদেশীদের বের করে দেয়ার এ প্রচেষ্টা বেশ বিতর্কিত হয়ে ওঠে। এ নিয়ে বারবার বাংলাদেশ রাইফেলস ও বিএসএফের মধ্যে গুলিবিনিময় হয়। ফলে একজনমাত্র ‘অনুপ্রবেশকারী’কেও বাংলাদেশে পাঠানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বিজেপির এই শক্তি প্রদর্শনের ফলে বিএসএফ ও বিডিআরের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে- পর্যায়ক্রমে শেখ হাসিনা (১৯৯৬-২০০১) ও খালেদা জিয়া (২০০১-২০০৬)-এর বিরোধপূর্ণ শাসনকালেও। ব্যর্থ ওই অভিযান সাধারণ বাংলাদেশী ও প্রতিরক্ষা, গোয়েন্দা সংস্থার মতো মূল সব প্রতিষ্ঠানকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে পাকিস্তানের ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স ও ভারতের উলফার মতো বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে। তারা সীমান্ত এলাকায় নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছিল তখন। সুষমা স্বরাজকে অবশ্যই অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং তাকে আতিথেয়তাকারীদের নিশ্চিত করতে হবে যে, বিজেপি তার নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে যে কথা বলেছিল তা শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে এবং তারা সে লক্ষ্য অর্জন করেছে। একই সঙ্গে তাদেরকে আশ্বস্ত করতে হবে যে, তার নেতৃত্বে সাউথ ব্লক তিস্তার পানি বণ্টন থেকে সব দ্বিপক্ষীয় ইস্যুকে আমলে নেবে। দ্বিতীয় দফায় এনডিএ সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে সদিচ্ছার যে ঐতিহ্য পেয়েছে তা থেকে যেন দূরে সরে না যায়।
লেখক ‘আউটলুক’ ম্যাগাজিনের সাবেক ডেপুটি এডিটর ও ডেইলি সানের সাবেক নির্বাহী সম্পাদক। (অনলাইন ফার্স্ট পোস্ট-এ প্রকাশিত লেখার অংশবিশেষ)