মোহাম্মাদ রাসেল আহমেদ, প্রবাসী লেখক, ফ্রান্স: মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এই মানুষই আবার গঠন, প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের কারণে দু’টি প্রজাতিতে বিভক্ত-নর ও নারী। বিশ্বে মানুষের ভূমিকায় নারীর অবস্থান ও অবদান অপরিহার্য বিষয়। তাই নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রসঙ্গটি অত্যন্ত গুরুত্বসহ মানব ইতিহাসে বহুলভাবে আলোচিত হয়ে আসছে। তবে জ্ঞানী সুধিজন স্বীকৃত সত্য যে, নারী সম্বন্ধে ভুল ধারণা তথা স্বার্থন্বেষী মহলের প্রতারণার কারণেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে নারী বিষয়টি বিভিন্ন মতাদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচিত হলেও তুলনামূলক ধর্মদর্শনের আলোকে মূল্যায়ন হয়নি বললে অতুক্তি হবে না। কারন আমরা এমন একটি সমাজে বাস করছি, যে সমাজে নারীদের নিয়ে আলাদা করে লিখতে হয়। সেক্ষেত্রে কি বোঝা যায় না, কী ধরণের সমাজে আমাদের বসবাস! এ এক এমন সমাজ যেখানে সভ্য সমাজের নামে অসভ্য শ্রেণির মানুষের ভার দ্বিগুণ।
নারী মুক্তি, নারীর মর্যাদা, নারীর অধিকার, নারীশিক্ষার কথা বলেছে ইসলাম আজ থেকে ১৪৩২ বছর আগে। কিন্তু বিশ্ববাসী তা শুনতে পায়নি। শুনলেও কান দেয়ার সময় পায়নি। এমন কি মুসলমানরাও বিষয়টা হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করেনি। ইসলামে নারী পুরুষ উভয়ের জন্যে বিদ্যার্জন ফরজ করা হয়েছে। জ্ঞান অর্জনের প্রশ্নে ইসলামে নারী পুরুষে কোন ভেদাভেদ বা ফারাক নেই। কিন্তু ধর্মান্ধ সমাজপতিরা নারীদের বঞ্চিত করেছে। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বেই এমনটি ঘটেছে। এখনও বহুদেশে নারীদের কেন্দ্র করে বহু ভুল ধারনা বিরাজ করে। ইসলাম একটি সর্বাধুনিক ধর্ম ও জীবন ব্যবস্থা। তবুও দেশে দেশে নারীরা পুরুষদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এর কারণ ধর্মান্ধ মৌলবাদী পরিচালকগন ইসলাম প্রদত্ত নারী অধিকার সম্পর্কে সজাগ নন। অথবা সজাগ থেকেও নারীদের সে অধিকার দিতে চাননি বা অধিকার প্রতিস্ঠায় প্রতিবন্ধকতা সৃস্টি করেছেন। মৌলবাদীদের ব্যর্থতার কারণে জনগণ মনে করেছে এটা ইসলামের ব্যর্থতা। আমাদের ধর্মগুরুরাও নারী অধিকার, নারীর মর্যাদা ও নারী শিক্ষার ব্যাপারে গণজাগরন সৃস্টি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এখনও ধর্মগুরুরা নারী অধিকারের ব্যাপারে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারছেন না।
দু:খ হলো আমাদের রাস্ট্রের কোন লক্ষ্য বা আদর্শ নেই। ফলে দেশের অর্ধেক মানুষকেই মানবেতর জীবন করতে হয়। নারী শোষণের আরেক বিরাট চারণভূমি হলো গ্রামবাংলা। গরীব নিরক্ষর নারীরা এখানে সবচেয়ে বেশী অবহেলিত ও নির্যাতিত। নারীর চরিত্রের অধঃপতন কিংবা নৈতিকতার অবক্ষয় যে পুরুষের কারণেই হচ্ছে, সে বিষয়ে কিন্তু কেউ প্রশ্ন তোলে না। এমনকি, পুরুষরাই যখন একজন অসহায় দরিদ্র নারীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জোরজবরদস্তি করে তাকে দিয়ে দেহ ব্যবসা করিয়ে নেয়, সে বিষয়েও পুরুষেরাই সবচেয়ে বেশি উদাসীন। পুরুষ যাই করবে সবই গুণ, নারীর বেলায় সবই দোষ। নারীর পোশাক নিয়ে পুরুষরা যে পরিমাণ চিন্তিত,সে পরিমাণ চিন্তা যদি নিজের ব্যক্তিত্ব গড়ার ক্ষেত্রে ব্যয় করতেন তবে তারা ব্যক্তিত্ববান মানুষই হতেন। ব্যক্তিত্বহীন ব্যক্তিরাই পোশাককে মুখ্য এবং যোগ্যতাকে গৌণ করে তোলে। যেভাবে নিবিষ্ট মনে নারীর শরীর প্রত্যক্ষন করেন, ঠিক সেভাবে যদি একনিষ্ঠভাবে নিজ জীবনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মনোযোগ দিতেন তবে সকলের কাছেই আদর্শবান মানুষ হতে পারতেন। এই দেশে সবচেয়ে নিরাপদ হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে ধর্মের মুখোশ পড়ে অধর্মের কাজে লিপ্ত হয়ে বেড়ায়। আর সবচেয়ে অনিরাপদ হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে কখনো কাউকে হত্যার হুমকি না দিয়ে শুধু কলম আর কীবোর্ড দিয়ে নিজের চিন্তাভাবনা তুলে ধরেছে সমাজের সকল কুসংস্কার অন্ধত্ব আর প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে। হাজার প্রতিকূলতার সত্ত্বেও যখন কোনো নারী দেশের জন্য লড়ে যায় নিরন্তর, তখন পুরুষেরা সুযোগ খুঁজে তাকে দিয়ে নোংরা কোনো মনস্কামনা পূরণ করিয়ে নিতে। এমনকি, এই অপবাদও ছড়ায় "যে নারী ঘর পরিবার ছেড়ে মাঠে নামে সে অসতী" অথচ ঘর পরিবার যে দেশের প্রয়োজনেই ছাড়ে সেটার কোনো মূল্য নেই এই বীর পুরুষদের চোখে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কোন পুরুষের একজন লড়াকু রাজনৈতিক নারী কর্মীর প্রাপ্য সম্মানটুকু দেওয়ার মত পুরুষত্ব নেই।