মঙ্গলবার, জুন ২৪, ২০১৪

'মেয়ে' বললেই সমাজের জিভে জল আসবে?

অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়
তাও ধরুন মাস ছয়েক তো হবেই -- কিছুটা কাজ আর কিছুটা হুল্লোড় ডিকিতে ঠেসে আমরা জনা পাঁচেক বন্ধু শান্তিনিকেতন গিয়েছিলাম |
ডিনারের পর বুনো গাছের নিঃশ্বাস গায়ে মেখে আমরা হাঁটতে বেরলাম | ঝিমিয়ে পড়া গেস্ট হাউসের আলো পিঠ থেকে মিলিয়ে গেল, এক চিলতে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ সঙ্গে নিয়ে আমরা লালচে ধুলোর গলিপথে এগোতে লাগলাম -- যেন রাত্তিরের নিঝুম গন্ধ আমাদের একমাত্র গন্তব্য! মোরামের অগোছালো শব্দ পায়ের আঙুল ছুঁয়ে কী বলছে টের পেতে না পেতেই মোটরবাইকের বেমানান আওয়াজ কানে এল -- খেয়াল করলাম, এক ব্যক্তি আমাদের পাশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে আবারও ফেরত আসছে | ততক্ষণে ইন্দ্রিয় সজাগ, কাব্য ঘুচে গেছে, আমরা প্রত্যেকেই নিশ্চিতভাবে বুঝছি মতলব ভাল নয় - এই ফিরে আসা, কাছে এসে স্পিড কমানো আসলে একটা ইঙ্গিত -- যার সর্বাঙ্গে পুরুষতন্ত্রের হেলমেট! আমরা বলতে চারজন মহিলা এবং একজন পুরুষ -- সচরাচর পাঁচ বন্ধু বলার পর এই জেন্ডার লেবেলিং-এর দরকার পড়ে না, কিন্তু এই লেখাটির ক্ষেত্রে এই তথ্যের গুরুত্ব আছে | স্বভাববশতই আমরা কয়েকজন সরাসরি সওয়ারির দিকে ধারালো চোখে তাকিয়ে রইলাম -- লোকটা একটু থমকালেও পুরোপুরি দমল না | যেন আমাদের মাধ্যাকর্ষণে আটকে গিয়ে একটু দূর দিয়ে প্রদক্ষিণ করতে লাগল | আমাদের মধ্যে কাররও নাম সৌর নয়, পদবি মণ্ডল নয় সুতরাং এই অশালীন ঘুরপাক অসহ্য লাগছিল... কেউ কিছু বলতেও যাচ্ছিলাম, এরই মধ্যে আমাদেরই কেউ একজন সাবধানী গলায় বলল সময়টা ভাল না, চল ফেরা যাক | রোজকার খবরের কাগজে মোড়া গণধর্ষণের ক্ষতবিক্ষত দিনলিপি আমাদের মনে উঁকি দিয়েছিল নিশ্চয়ই | ফিরতি পথে আমাদের পুরুষ বন্ধুটি একটু গম্ভীরভাবে বলল "তোমরা আমার সামনে হাঁটো, আমি বরং পেছনে থাকি... যদি..."
না, তার আশঙ্কা সত্যি হয়নি... আমরা নির্বিঘ্নে গেস্টহাউস ফেরেছিলাম ঠিকই কিন্তু প্রবল অস্বস্তি নিয়ে বুঝতে পারছিলাম, এক লহমায় একজন মানবাধিকার অ্যাক্টিভিস্ট, একজন ডিজাইনার এবং দুজন মনোবিদ কীভাবে শুধুমাত্র চারজন মহিলা হয়ে উঠতে পারে -- যেন একটি বিশেষ লিঙ্গের ব্র্যাকেট আমাদের একমাত্র পরিচয়!
অনেকেই আমরা একটা অমীমাংসিত প্রশ্নের সামনে বার বার হোঁচট খাচ্ছি -- এত যে নারী প্রগতি, নারী স্বাধীনতার লড়াই -- শিক্ষায়, শিল্পে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের পারদর্শিতা - এত বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা -- সব কি তাহলে মিথ্যে? তবে কি আজও মেয়ে বললেই শুধুমাত্র ভোগের রসদ বলে সমাজের জিভে (বাঅন্য কোথাও) জল আসবে ? উত্তরটা আসলে হয়ত প্রশ্নের মধ্যেই আছে | মেয়েরা সত্যি নিজেদের দাপটে আজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে আপসহীন ভূমিকা নিচ্ছে তার ধাক্কায় সমসাময়িক পৌরুষ থতমত | মেয়েরা আজ আর জয়যাত্রায় যাও গো বলে দাঁতে ধান দুব্বো কেটে পুরুষ সঙ্গীটিকে রথে তুলে দিয়ে রান্নাঘরে চোখ মুছছে না, বরং নিজে আরেকটা রথ কিনে 'আমার রয়েছে কর্ম আমার রয়েছে বিশ্বলোক' অবলীলায় বলতে পারছে -- মেয়েদের হাতঘড়ি এখন রাত্তিরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শহরের পথে ঝলসে উঠছে, মেয়েরা নিজেদের সম্মান আগলে নেওয়ার ভাষায় শান দিচ্ছে, নিজের যৌন আবেদন নিয়ে কুণ্ঠিত না হয়ে আদরের দাবি জানাচ্ছে ... এখন এই পরিবর্তিত নারীসত্ত্বা স্বাভাবিকভাবেই প্রথাগত জেন্ডার রোলের প্রতিটি প্রচ্ছদকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে | মুশকিল হল, অধিকাংশ পুরুষ এই নতুন নারীর কাছে নিজের পৌরুষ নিয়ে একধরনের সংশয়ে ভুগছেন -- লিঙ্গ বৈষম্যে হেলান দিয়ে উদযাপন করা সামাজিক, পারিবারিক, পেশাগত এবং অর্থনৈতিক একাধিপত্যে নারীর সমানাবস্থান নিজেদের সক্ষমতার গায়ে ঝুলিয়ে দিচ্ছে প্রশ্ন চিহ্ন -- যার জন্য এই হীনমন্যতার উৎপত্তি অতএব সেই নারীকুলের প্রতি তৈরি হচ্ছে অসংযত রাগ -- এবার রণে বনে জঙ্গলে, একাকী বা দঙ্গলে মেয়েদের ওপর চড়াও হয়ে পুরুষ প্রথমে তার যৌনাঙ্গের তারপর সর্বাঙ্গের ক্ষমতা জাহির করছে | ধর্ষণ এখানে চুরি করে ছিনিয়ে নেওয়া যৌনতা নয়, বরং লিঙ্গ রাজনীতির এক ঘৃণ্য হাতিয়ার | যে কারণে আমরা সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ধর্ষণের বিবরণ পড়ে আঁতকে উঠছি -- দিল্লির চলন্ত বাস হোক বা কামদুনির নির্জন পথ -- একদল অপরিচিতি পুরুষ কিংবা পরিচিত মুখের অন্ধকার চাউনি -- ঘটনার সূত্রপাত থেকে উপসংহার প্রায় একই ছকে বাঁধা -- অবাঞ্ছিত যৌনতা -- অবর্ণনীয় হিংস্রতা এবং তারপর হয় হত্যা না হলে মৃত্যু নিশ্চিত করে চম্পট ! আর হ্যাঁ, সঙ্গে কেউ থাকলে বা কেউ রুখলে তাকেও গুঁড়িয়ে দেওয়া ... বোঝাই যাচ্ছে শুধুমাত্র যৌন আকর্ষণ কখনই এহেন আচরণের ভিত্তি হতে পারে না | যৌন হিংসার মধ্যে হিংসাটাই মুখ্য |
এমন ভাবার কোনও মানে নেই যে বাড়ির মধ্যে নারী নিরাপদ -- একাধিক পুংলিঙ্গের নিজেদের ঝামেলাতেও ধর্ষিত হচ্ছেন তাদেরই কারওর ঘরনী | ছিন্ন নারী শরীর যেন একের প্রতি অন্যের হুমকির নথিপত্র ! এছাড়া কাঙ্খিত পুরুষ বা অনাকাঙ্খিত পুরুষ তাকে ছোঁবেন না এড়িয়ে যাবেন সেটাও আগাগোড়া তাদেরই মর্জি -- নিজের যৌনসত্ত্বার ওপর নারীর নিজের অধিকার বহু পুরুষের কাছে বিদেশি ভাষার মতো দুরূহ | যেন নারী নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়া মানে আবারও খোঁচা খাওয়া পৌরুষে এক চিমটে নুন |
তবে সব পুরুষ সম্ভাব্য ধর্ষক এমন ভাবনা আবার আশকরা দেবেন না | বহু পুরুষ এখনও তার প্রিয় নারীর একটি মাত্র হ্যাঁ শোনার জন্য দশক পার করে দিতে পারেন -- কোনও অপরিচিতার বিপদে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা করেন না -- অথবা অদম্য প্রেম এবং আকর্ষণ বহু চেষ্টার পরও যখন 'না' হয়ে যায় তখন বন্ধুত্বের টেবিলে কফির কাপ সাজাতে পারেন... পারেন, কারণ তাদের নিজের পৌরুষ প্রমাণের দায় নেই! তারা জানেন নারী শক্তির উত্থান মানে তাদের পতন নয় | এটা তো আর প্রতিদ্বন্দ্বিতার ময়দান নয়, একটা পরিপূরক সম্পর্ক -- যেখানে যৌনতা, প্রেম, অভিমান, এমনকী রাগ পারস্পরিক সম্মানের সঙ্গে জুড়ে আছে | নিজের অবস্থান নিয়ে যদি সত্যি আত্মবিশ্বাস থাকে তাহলে মেয়েদের এগিয়ে চলায় পুরুষদের পায়ের নিচে ফোস্কা পড়ার কথা নয় |
একটি গণধর্ষণে আসলে কিন্তু একটি মাত্র নারী নির্যাতিত হন না -- বয়স, শ্রেণী, শিক্ষা, রজ্য, নির্বিশেষে একাধিক মহিলাকে জানান দেওয়া হয় যে তারা আসলে অসুরক্ষিত, সুতরাং যেন আর সমাজের এঁকে দেওয়া স্থান কালের গণ্ডির বাইরে পা না বাড়ান | এরপর নিয়মিত নারী নিগ্রহের ঘটনা শুনতে শুনতে মেয়েরা এক সময় নিজেরই চারপাশে নিয়মের রেখা টানতে শুরু করেন... আর ঠিক সেটাই কিন্তু পিতৃতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সাফল্য! কিছুটা ভয় এমনভাবে মগজের খোপে চালান করে দেওয়া যাতে ভাবনার স্বাধীনতা মাথা তুলতে না পারে |
আজ মনে হয় শান্তিনিকেতনের সেই রাত্রে আমরা হয়ত অক্ষত শরীর ফিরেছিলাম, কিন্তু খুইয়ে এসেছিলাম কিছুটা মেরুদণ্ডের জোর... কে জানে, হয়ত কোনওদিন আবার সেই অসমাপ্ত পায়চারি ফেরত পাব... আশা করি সেদিন নিজের নারীত্বের গঠন আমার একমাত্র পরিচয় হবে না!