মঙ্গলবার, জুন ২৪, ২০১৪

পতিতাবৃত্তির বাস্তবতায় ১৪বছরের ব্রাজিল কিশোরী

আকস্মিক পরিস্থিতিতে মেয়েটির পা দুটি কাঁপছিল। গাছের পেছনে লুকিয়ে পড়লো সে। গোপনে কথা বলতে এ সাবধানতা। মেয়েটির নাম তানিয়া। কোঁকড়া চুল। দুঃখভরা বাদামি রঙের বড় বড় চোখ। ওজন বড় জোর ১০০ পাউন্ড। বয়স ১৯ বলে দাবি করলেও সম্ভবত বয়স আরও কম।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে দেহবিক্রি শুরু করেছিল বলে স্বীকার করলো সে। কানাডার সিবিসি নিউজের প্রতিবেদনে এভাবেই উঠে এসেছে ব্রাজিলে কিশোরী পতিতাবৃত্তির বাস্তবতা। তানিয়া এখন দুই সন্তানের জননী। একজনের বয়স ৩ বছর। অপরজন দুই মাসের। ওইদিন সকালে কোন খদ্দের মেলেনি। মাঝরাত পর্যন্ত নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষা করে পার করে দিলো দিন। মাত্র ১৫ ব্রাজিলিয়ান ডলারের বিনিময়ে খদ্দেরদের সাময়িক আনন্দের খোরাক হয় তানিয়ার মতো এমন অনেক কিশোরী। বিকিনি পরা লাস্যময়ী নারী আর সেক্সের প্রতি উদারমনা দৃষ্টিভঙ্গিদের জন্য ব্রাজিল সুপরিচিত। এখানে পতিতাবৃত্তি বৈধ।
আবার পতিতাবৃত্তিতে শিশুদেরকে অন্যায়ভাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বিশ্বের অন্যতম জঘন্য রেকর্ড তাদের। ১৮ বছরের নিচে কোন ছেলেমেয়ের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক আইনগত অপরাধ। সমপ্রতি আইনও আগের থেকে শক্ত করা হয়েছিল। তারপরও আড়াই লাখ থেকে পাঁচ লাখ কিশোর- কিশোরীর মধ্যে বলতে গেলে সবাই দরিদ্র। আর প্রত্যেকেই দেহবিক্রি করে। যারা শিশু পতিতাবৃত্তি রোধে কাজ করে থাকে তাদেরকে বিশ্বকাপের আগমনে ওভারটাইম কাজ করতে হচ্ছে। এমনই একটি প্রতিষ্ঠান হ্যাপি চাইল্ড ইন্টারন্যাশনাল। বৃটিশভিত্তিক ওই দাতব্য প্রতিষ্ঠানের কাউন্সেলর ও ম্যানেজার রুবিয়া উচোয়া বলেন, এটা ফুটবল, সমুদ্রসৈকত, নারী আর শোচনীয় দরিদ্রতার এক সমন্বয়। বিশ্বকাপের একটি ভেন্যু রেসিফে শহরে।
এখানে বিদেশী পর্যটকদের কাছে ১ লাখ ২০ হাজার টিকিট বিক্রি হয়েছে। উচোয়া বললেন, মেয়েরা জানে যে সাদারা আসছে, আর তাদের পয়সা আছে। তারা ব্রাজিলে আমোদ করতে আসে। যৌন পর্যটন ব্রাজিলে খুব খোলামেলাভাবে উৎসাহিত করা হয়। হোটেল আর ট্যাক্সিগুলো এই নেটওয়ার্কের একটি অংশ। যাদের মধ্যস্থতায় খদ্দেরদের সঙ্গে যৌনকর্মীদের যোগসূত্র স্থাপন হয়। অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের জায়গায় থাকে অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরী। বিশ্বকাপকে সামনে রেখে কিছু যৌনকর্মী ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেছে যেন তারা আরও ভালভাবে বিদেশী খদ্দেরের সঙ্গে আলাপচারিতা সারতে পারে। এমনকি কিছু ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছে মেয়েদের মেন্যুও নাকি আছে।
জিজ্ঞাসা করলে দেখাবে আর কি! সে বলবে, আপনার কেমন পছন্দ- ব্লন্ড, ব্রুনেট, মোটা, লম্বা, কমবয়সী মেয়ে নাকি বয়সী নারী? উচোয়া বললেন, এটা দুঃখজনক যে, এটাই এখানে প্রচলিত রীতি। হ্যাপি চাইল্ড প্রতিষ্ঠানটি কিশোর-কিশোরীদের পুনর্বাসনে নিরাপদ আবাস পরিচালনা করে বেলো হরাইজোন্তে শহরে। এটাও একটা বিশ্বকাপ ভেন্যু। ব্রাজিলের উত্তর-পূর্বে অন্যতম দরিদ্রতম এলাকা রেসিফেতে তারা সমপ্রতি সন্তানসহ তরুণীদের জন্য নিরাপদ আবাস চালু করেছে। তারা হতে পারে পতিতাবৃত্তি বা যৌন নির্যাতনের শিকার। উচোয়া বলেন, যৌন নির্যাতন অনেক ছেলেবেলায় শুরু হয়। অনেক ক্ষেত্রে সেটা হয় বাসার ভেতরেই। কখনও তাদের নিজের জন্মদাতা পিতা বা কখনও সৎ বাবার দ্বারা। যখন তারা বড় হয় আর শারীরিক পার্থক্য বুঝতে শুরু করে তখন উপলব্ধি করে যে, অর্থ উপার্জনের জন্য এটা একটা রাস্তা। কখনও কখনও মেয়েদের বাবা-মা তাদেরকে পতিতাবৃত্তিতে উৎসাহিত করে।
এটা বয়সের বিষয় নয় বরং ফিগারের বিষয়। যদি তাদেরকে নারীদের মতো দেখতে লাগে তাহলেই ঠিক আছে। এবার শুরু করার সময় এসেছে। এভাবেই পতিতাবৃত্তি নিয়ে সেখানকার সামাজিক মনোভাব তুলে ধরলেন উচোয়া। বিশ্বকাপকে সামনে রেখে হ্যাপি চাইল্ড ‘ইটস এ পেনাল্টি’ শীর্ষক একটি প্রচারণা শুরু করেছে। একই শিরোনামে তারা দেড় মিনিটের একটি ভিডিও তৈরি করেছে যা ইউকে থেকে ব্রাজিলের কয়েকটি ফ্লাইটে প্লে করা হবে। অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের সঙ্গে যৌন সংসর্গ আইনগত অপরাধ সে বিষয়ে ভিডিওটিতে সতর্ক বার্তা দেয়া হয়েছে। ভিডিওতে সাবেক বৃটিশ খেলোয়াড় গ্যারি লিনেকার, ব্রাজিলের ডেভিড লুইজ পর্যটকদের উদ্দেশে এ সতর্ক বার্তা দিয়েছেন। ব্রাজিল বলছে, ইংরেজি ও পর্তুগিজ ভাষায় প্যাম্ফলেট, পোস্টার দিয়ে তারা যৌন অনাচার রোধে বিমান আর সমুদ্র বন্দরগুলোতে তথ্য প্রচারণা শুরু করেছেন। তবে ব্রাজিলের পাঁচ পাঁচটি বিমানবন্দর ঘুরেও তেমন কোন পোস্টার চোখে পড়েনি সিবিসি’র প্রতিবেদক দলের।
স্থানীয় অনেকের অভিযোগ ব্রাজিলে শিশু পতিতাবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আর তা কমিয়ে আনতে কর্তৃপক্ষ অক্ষম। দরিদ্র বস্তি এলাকার (স্থানীয়ভাবে ‘ফাভেলা’ বলা হয়) অনেক মেয়েরা স্কুলে যায় না। অনেককে দেখা যায় অল্প বয়সে অন্তঃসত্ত্বা। রেসিফের কমিউনিদেদ ডস কোয়েলহস নামক এমন একটি দরিদ্র ফাভেলাতে গিয়ে কথা হয় ১৫ বছর বয়সী জিন-এর সঙ্গে। তার কোলে ৫ মাসের এক সন্তান। প্রথমে কথা বলতে ইতস্তত করে জিন। পরে তার কাছ থেকে জানা যায়, মাত্র ১০ বছর থেকে দেহব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে সে। মাঝখানে এক বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে লিভ টুগেদারের সময় বাদ ছিল সেটা।
তার সন্তানের পিতা ওই বয়ফ্রেন্ড মাদক ব্যবসার কারণে কারাগারে থাকায় পুনরায় নামতে হয়েছে একই রাস্তায়। ছোট্ট মেয়ের মুখে খাবার তো তুলে দিতে হবে। ফাভেলা থেকে বেরিয়ে আসার সময় জিন দৌড়ে আসলো। কি যেন বলবে সে। এবার কোন সংকোচ নেই চোখে-মুখে। উজ্জ্বল চেহারা নিয়ে বললো, ‘কানাডার মেয়েদেরকে বলো, এর মধ্যে না ঢুকতে। এটা ভাল জীবন না।