নিউইয়র্কের স্ট্র্যান্ড বুক স্টোরে ঢুকতেই চোখ পড়ল বড় আকারের একটা ব্যানার ঝুলছে, তাতে লেখা ‘আলবের কাম্যু—জন্মশতবর্ষের উদ্যাপন’। এর নিচেই একটা টেবিলজুড়ে কাম্যুর যত উপন্যাস আর এগুলোর ওপর খাড়া করে রাখা আলজেরিয়ানক্রনিকলস,
কাম্যুর ইংরেজিতে সদ্য প্রকাশ হওয়া শেষ বই। ইউনিয়ন স্কয়ারের কাছের এই বহুতল বইয়ের দোকানটিতে আমার যাওয়ার অন্য এক ‘অ্যাবসার্ড’ কারণ রয়েছে। এই দোকানেই দীর্ঘ সাত-আট বছর কাজ করেছেন আমাদের প্রয়াত চলচ্চিত্রকার
তারেক মাসুদ। আমি নিউইয়র্ক গেলেই তারেক মাসুদের যুবক বয়সের স্মৃতিধন্য এই দোকানে যাই মূলত এক অজানা টান থেকে—এর সিঁড়ির ধাপে ধাপে যেন এখনো ঝুলে আছে তাঁর ছায়া, আর আমি যেন তা চাইলেই ছুঁতে পারব। এ চিন্তাটিই ‘অ্যাবসার্ড’—জীবন ও মৃত্যুর দ্বৈতধর্মকে অস্বীকার করতে চাওয়া আমার এই দুঃখবিলাস!
এই ‘অ্যাবসার্ডিটি’কে আলবের কাম্যুর মতো করে ভাষা দিতে আর কোনো লেখক পেরেছিলেন বলে জানা নেই। কাম্যু তাঁর অতি সরল গল্পকথনে জীবনের যে অর্থহীনতাকে ফুটিয়ে তোলেন, তা আমাদের ভীষণভাবে নাড়িয়ে দেয়, জীবনের নানাবিধ সত্যের সামনে দ্বিধান্বিত করে। বিশ্বব্যাপী আলবের কাম্যুর প্রবল জনপ্রিয়তার এটাই কারণ। বেশ কঠিন ভাষা ও কঠিন বয়ানের অস্তিত্ববাদী দার্শনিক হওয়া সত্ত্বেও কথাশিল্পী কাম্যু যখন মাত্র ৪৬ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান, এর মাত্র তিন বছর আগে ৪৩ বছর বয়সে তিনি জিতে নেন সাহিত্যে দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম নোবেল বিজয়ীর অভিধা; তখন তাঁর জনপ্রিয়তা কোনো সেলিব্রেটি রক স্টারের মতোই। জীবনসত্যের দ্বৈততাগুলো—সুখ ও দুঃখ, আলো ও অন্ধকার, বাঁচা ও মরা—কাম্যুতে এসে প্যারাডক্স বা কূটাভাসের চেহারা নিয়ে নেয়: মৃত্যু আছে জানা সত্ত্বেও এবং এই ব্রহ্মাণ্ড সে বিষয়ে নীরব, তা জেনেও আমরা আমাদের জীবনকে মূল্য দিই। দ্বৈততার মধ্যে বাস করা সম্ভব (কাম্যুর ভাষায়: দুঃখের পর্বগুলো আমি মেনে নিতে পারি। কারণ, আমি জানি এর পরে হয়তো আমার সুখের অভিজ্ঞতালাভ হবে।), কিন্তু প্যারাডক্সের
মধ্যে নয় (আবার তাঁর ভাষায়: ‘আমি জানি, আমার জীবনের বিরাট মূল্য আছে, কিন্তু আমি এটাও জানি যে জীবন মূল্যহীন’)।