ইংল্যান্ড-উরুগুয়ের ম্যাচঘড়ির কাঁটা তখন সবে ঘণ্টা পেরিয়েছে। বল দখলের লড়াইয়ে দুর্ঘটনাবশত রাহিম স্টারলিংয়ের হাঁটু গিয়ে লাগে আলভারো পেরিরার মাথায়। শুরুতে মনে হচ্ছিল জ্ঞানই হারিয়েছেন উরুগুয়ের ডিফেন্ডার। সেটি না হলেও সাইডলাইনে নিয়ে গিয়ে দলের চিকিৎসকরা তাঁকে তুলে নেওয়ার সংকেত দেন। কিন্তু সেটি মানলেন কই পেরিরা! পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে জোরে মাথা এবং সজোরে হাত নেড়ে জানান যে কিছুতেই বদলি হবেন না। সিংহের বিক্রমে বাকি ম্যাচটুকু খেলে দেন ঠিক।
কোথায় আলভারো পেরিরা আর কোথায় ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো! ফুটবল সাম্রাজ্যের সম্রাট একজন, অন্যজন প্রায় অচেনা এক প্রজা। কিন্তু সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে পেরিরার ওই খেলার জন্য আকুলতার ছবিটা তাঁকে জায়গা করে দিয়েছে রোনালদোর ক্যানভাসে। নাছোড়াবান্দার মতো পিছু লেগে থাকা ইনজুরির চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে, চিকিৎসকদের পরামর্শ কানে না তুলে আর দীর্ঘদিনের জন্য মাঠের বাইরে ছিটকে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েও খেলতে চান রোনালদো। যেকোনো মূল্যে। সব কিছুর বিনিময়ে।
বৈশ্বিক শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট যাঁর মাথায়, বিশ্বকাপ থেকে কী করে স্বেচ্ছায় সরে যান তিনি!
আজ তাই যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে রোনালদো মাঠে নামছেনই। তাঁর বরফমোড়ানো বাঁ পায়ের ছবি গণমাধ্যমে এলেও তিনি খেলছেন, খেলছেন ট্রেনিং থেকে বাধ্যতামূলক ছুটির খবর ফুটবলাকাশে উড়ে বেড়ানো সত্ত্বেও। জার্মানির কাছে ০-৪ গোলে হেরে পর্তুগালের বিশ্বকাপ-স্বপ্নে পড়েছে বিষাদের পোঁচ। সেটিকে আবার উৎসবের রঙে রাঙিয়ে দেওয়ার জন্য ফিফা-ব্যালন ডি’অর জয়ী মরিয়া। কক্ষচ্যুত পর্তুগিজ এক্সপ্রেসকে আবার কক্ষপথে ফিরিয়ে আনার মিশনে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে নিশ্চিতভাবেই দেখা যাবে পর্তুগিজ অধিনায়ককে।
ফিটনেস নিয়ে বরাবর বড্ড সিরিয়াস রোনালদো। সেটি ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই। কিভাবে সবার আগে ট্রেনিংয়ে এসে সবার শেষে যান কিংবা সতীর্থদের ছুটি কাটানোর সময়ও জিমে কতটা সময় কাটান- এ নিয়ে পুরনো ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের উচ্ছ্বাস ছিল। প্রতিদানও পাচ্ছিলেন রোনালদো। ইনজুরির কারণে কদাচিৎই কোনো খেলা মিস করেছেন পাঁচ-ছয় বছর।
কিন্তু রোনালদো এমনই দুর্ভাগা যে, সেই ইনজুরিটা জেঁকে ধরল বিশ্বকাপের ঠিক আগে আগে!
রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ক্লাব মৌসুমের শেষ দিক থেকে ভোগা শুরু। এরপর দ্রুত মাঠের ফেরার চেষ্টা স্বরূপে ফেরার দিনটা পিছিয়েছে ক্রমেই। এই যে জার্মানির বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে মাঠে নেমে গেলেন রোনালদো, সেটিও নাকি চিকিৎসকদের পরামর্শ উপেক্ষা করে। বিশ্বমঞ্চে নিজেকে প্রমাণের তাড়নাই ছিল তাঁর প্রেরণা। তাতে কাজের কাজ হয়নি কিছু। নিজে জ্বলে উঠতে ব্যর্থ, আর রাজ্যহারা রাজার মতো অসহায়ভাবে দেখেছেন দলের ০-৪ গোলের আত্মসমর্পণ। কিন্তু সব তো এখনো শেষ হয়ে যায়নি। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ম্যাচে ফিরছেন তিনি। ফিরছেন পর্তুগিজ ক্যাম্পের অন্ধকার দূর করে তা আলোয় ভাসিয়ে দিতে।
জার্মানির কাছে হারের পর থেকে টু শব্দটি আর নেই রোনালদোর মুখে। হয়তো গর্জনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন বলেই। তবে সতীর্থ মিগেল ভেলেসো পরশুর ট্রেনিং শেষে আশ্বস্ত করেছেন সমর্থকদের, ‘আমি তো ডাক্তার নই। তবে যতটুকু দেখেছি, রোনালদোকে ভালোই মনে হয়েছে। ও ঠিকঠাক ট্রেনিং করছে, লাফাচ্ছে, বলে শট নিচ্ছে। এর চেয়ে বেশি আর কী বলার আছে!’ ওই অতটুকুন সত্যি হলেই বর্তে যায় পর্তুগালের সমর্থকরা। যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ফুটবল-রাজার রাজকীয় প্রত্যাবর্তনের মঞ্চ যে প্রস্তুত হয়ে যায় তাতে!
আর সেটি ব্রাজিল বিশ্বকাপের জন্য বড্ড প্রয়োজনও। সুন্দর ফুটবলের আঁতুড়ঘরে ফিরে সৌন্দর্যের সবটুকু নিয়ে ধরা দিচ্ছে এবারের বিশ্বকাপ। গোল হচ্ছে অনেক বেশি। আর অন্য সময়ের মতো অহরহ তারকা পতন নয়, বরং তারকাদের উজ্জ্বল হয়ে জ্বলজ্বল করাই এখন পর্যন্ত ব্রাজিল বিশ্বকাপের বৈশিষ্ট্য। লিওনেল মেসি, নেইমার, লুই সুয়ারেস, করিম বেনজিমা, থোমাস ম্যুলার, এডেন হ্যাজার্ড- কে জ্বলে ওঠেননি! অথচ সেই উজ্জ্বল নক্ষত্রমণ্ডলে কিনা সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকাই আলো ছড়াচ্ছে মিটিমিটি করে!
রোনালদোর বিধ্বংসী শ্রেষ্ঠত্বে ফেরা তাই শুধু তাঁর দায় না, ব্রাজিল বিশ্বকাপেরও চাওয়া। অতএব যুক্তরাষ্ট্র সাবধান!