ঈদের আগে চাঁদাবাজির ধুম পড়েছে রাজধানীতে। সড়ক থেকে ফুটপাত, মার্কেট থেকে বাসাবাড়ি, কাঁচাবাজার, লঞ্চঘাট, বাস টার্মিনাল সর্বত্র চলছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক পাহারা সত্ত্বেও চাঁদাবাজরা ঈদ বখশিশের নামে দুই হাতে চাঁদা তুলছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে যেমন চাঁদাবাজি হচ্ছে, তেমনি হচ্ছে সরকারি দলের অঙ্গ সংগঠনের নামেও। চাঁদাবাজি হচ্ছে টেলিফোনেও। কোনো কোনো স্থানে আবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ক্যাডাররা জোট হয়ে চাঁদাবাজি করছে। ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে, চাঁদাবাজদের দৌরাত্দ্য ততই বাড়ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চলতি মাসে র্যাব ও পুলিশের কাছে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি চাঁদা দাবি ও হুমকির আশঙ্কা করে অভিযোগ করেছেন। এ ছাড়া রাজধানীতে চাঁদার দাবিতে হুমকি-ধমকি ও হামলার ঘটনা ঘটছে। চাঁদা না পেয়ে মতিঝিলে সন্ত্রাসীরা গুলি করে এক ঠিকাদারকে হত্যা করেছে। সন্ত্রাসী চাঁদাবাজদের পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কিছু সদস্যও চাঁদাবাজিতে ভীষণ ব্যস্ত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশের লাইনসম্যান, কোথাও কমিউনিটি পুলিশের সদস্যরা চাঁদাবাজদের সোর্স হিসেবে কাজ করছেন। পুলিশ ও ব্যবসায়ী দুই পক্ষের সঙ্গেই কমিউনিটি পুলিশের ঘনিষ্ঠতা থাকায় চাঁদাবাজির অনেক ঘটনাই এখন আর প্রকাশ পাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা জানান, চাঁদাবাজদের মোকাবিলায় ব্যবসায়ীরা পুলিশের চেয়ে নিজেদের কৌশলকেই কার্যকর বলে মনে করছেন। এ কারণে অনেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের হাত করে নিয়েছেন। মৌসুমি চাঁদাবাজদের রুখতে ভাড়াটে মাস্তানদেরও রাখা হয়েছে কোথাও কোথাও। তাদের মাধ্যমেই দেনদরবারের পর চাঁদাবাজদের বিদায় করা হচ্ছে। তারা জানান, এখন আর অভিযোগ করে কোনো লাভ নেই। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঈদ বাজার পাড়ি দিতে হবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) কৃষ্ণপদ রায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, 'ঈদ বা এ ধরনের উৎসবের আগে চাঁদাবাজির প্রবণতা লক্ষ করা গেলেও এবার অনেক কম। তবে টেলিফোনে চাঁদাবাজির কিছু অভিযোগ আসছে। খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া পেশাদার কিছু চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তারা জামিনে ছাড়া পেয়েছেন বলে আমাদের কাছে খবর এসেছে। তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।'
জানা গেছে, সন্ত্রাসীরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের কাছে চিরকুট পাঠিয়ে ঈদ সালাম পেঁৗছে দিচ্ছেন। চিরকুটে সন্ত্রাসীরা চাঁদা দেওয়ার নির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ করে দিচ্ছেন। মিরপুরের একজন গার্মেন্ট ব্যবসায়ীর কাছে রমজানের শুরুতেই ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে সালাম পেঁৗছে দেন চাঁদাবাজরা। তিনি এ নিয়ে কোনো ঝামেলা তৈরি করতে চাননি বলে সমঝোতার মাধ্যমে চাঁদার অঙ্ক কমিয়ে তাদের বিদায় করেছেন। তিনি বলেন, রোজার শুরু থেকে সন্ত্রাসীরা নীরবে চাঁদা তোলার কাজ শুরু করেছে। তার মতো অনেকের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। তেজগাঁও শিল্প এলাকার একজন প্যাকেজিং ব্যবসায়ী চাঁদাবাজদের কারণে অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। ওই ব্যবসায়ীর অভিযোগ, রমজানের শুরু থেকে তিনি সাতজনকে হাসিমুখে বিদায় করেছেন। এখন তিনি আর পারছেন না। ব্যবসা যেহেতু করতেই হবে, সন্ত্রাসী চাঁদাবাজদের তিনি খেপিয়ে তুলতে চান না বলে পুলিশের কাছেও অভিযোগ করেননি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানীর মার্কেট ও বিপণিবিতানগুলোয় চলছে নীরব চাঁদাবাজি। মিরপুরের মুক্তিযোদ্ধা সুপার মার্কেট, মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্স, কো-অপারেটিভ মার্কেট সোসাইটি, শাহআলী শপিং কমপ্লেঙ্, নিউমার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট, তালতলা সুপার মার্কেট, গুলিস্তান হকার্স মার্কেট ও পুরান ঢাকার বেশির ভাগ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এসব স্থানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী পরিচয় দিয়ে চাঁদা তোলা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানান, শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত বাহিনীর সদস্যরাও এখন নিজেদের ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী বলে পরিচয় দিচ্ছেন। ইসলামপুরের কাপড় ব্যবসায়ীরা জানান, ডাকাত শহীদ নিহত হলেও তার ক্যাডাররা সক্রিয়। তাদের কারণে আতঙ্কিত ব্যবসায়ীরা। ঈদের কারণে কারওয়ান বাজারে চলছে চাঁদাবাজির মহোৎসব। পিচ্চি হান্নান, সাহাবুদ্দিন ও মুরগি ফারুক নিহত হওয়ার পর এখন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির একাধিক স্থানীয় নেতা চাঁদাবাজির হাল ধরেছেন বলে আড়তদাররা জানিয়েছেন। আগে প্রতি রাতে সেখানে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকার চাঁদাবাজি হলেও এখন আদায় হচ্ছে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা। মৌচাক ও সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় ছাত্রলীগ নামধারী শিমুল ও মাসুমের নেতৃত্বে চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন। ইসলামপুরের কাপড় ব্যবসায়ী শামসুল আলম জানান, ডাকাত শহীদের ক্যাডারদের পাশাপাশি নতুন নতুন সন্ত্রাসীদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। এক সপ্তাহ আগে বিদ্যুৎ গ্রুপের সদস্যরা তার কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। ১ লাখ টাকা দেওয়ার পর সন্ত্রাসীরা আর বিরক্ত করেননি। চাঁদা দেওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ব্যবসা করতে হলে চাঁদা না দিয়ে উপায় নেই। ঈদ সামনে রেখে প্রতিদিনই চাঁদাবাজরা অন্তত ২৫-৩০ জনের কাছে টেলিফোনে চাঁদা দাবি করেন। নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ব্যবসা করছেন সবাই। এলাকায় পুলিশি টহল তেমন একটা থাকে না। যাত্রাবাড়ীর ব্যবসায়ী হাসান আলী র্যাবের কাছে অভিযোগ করেন, 'চাঁদাবাজরা আমার কাছ থেকে মোবাইল ফোনে চাঁদা দাবি করেছে। এক পর্যায়ে কিছু টাকা দিতে তিনি রাজি হয়েছি। কিন্তু ওই সন্ত্রাসী রাজি হচ্ছে না। সে বলে দিয়েছে, পুরো ১ লাখ টাকা না দিলে আমাকেসহ পরিবারের কাউকে ঈদ করতে দেবে না।' গাউছিয়া ও নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, স্থানীয় সন্ত্রাসীরা ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ নেতাদের নামে চাঁদাবাজি করছেন। তিনি আরও অভিযোগ করেন, পুলিশ ও তাদের সোর্সেরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করছেন।
পরিবহন সেক্টরে মালিক-শ্রমিক সংগঠনের ব্যানারে কেবল রাজধানীতেই সাড়ে ১০ হাজার বাস-মিনিবাস থেকে প্রতিদিন চাঁদা ওঠে অর্ধকোটি টাকারও বেশি। মালিক-শ্রমিকের কল্যাণের কথা বলেই বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে এ চাঁদা তোলা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পরিবহনে চাঁদাবাজির সঙ্গে পুলিশ একেবারে ওতপ্রোতভাবেই জড়িয়ে পড়েছে। ট্যাঙ্কি্যাব থেকে শুরু করে হিউম্যানহলার, বাস, ট্রাক কিছুই চলতে পারছে না চাঁদা পরিশোধ না করে।