আমাদের সমাজে এখনো বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা প্রচলিত আছে। এর মূল কারণ শিক্ষার অভাব, অর্থনৈতিক ও সচেতনতার অভাব। পাইলস ও জন্ডিস রোগে হাতুড়ে চিকিৎসার দৌরাত্ম্য বেশি। এই রাজধানীর অসংখ্য লাইটপোস্টে হাতুড়ে ডাক্তারদের তথাকথিত বিনা অপারেশনের পাইলসের চিকিৎসার সাইনবোর্ড দৃশ্যমান। এসব সাইনবোর্ড ও হাতুড়ে চিকিৎসকদের সমারোহ সবচেয়ে বেশি নামকরা বাস স্ট্যান্ডগুলোর আশপাশে।
আমাদের দেশের অজস্র মানুষ এসব হাতুড়ে চিকিৎসকদের খপ্পরে পড়ে আজীবনের জন্য মলদ্বার সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেছেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এসব ভুক্তভোগী নিকটাত্মীয়দের কাছেও তাদের দুরবস্থার কথা প্রকাশ করেন না। লোকলজ্জার ভয়ে এবং নিজের বোকামি প্রকাশ হয়ে পড়বে ভেবে কেউ প্রকাশ করেন না। শুধু চিকিৎসকদের কাছে এসব তারা ব্যক্ত করেন। অনেকে তার স্ত্রীকেও জানান না। অনেক রোগী বলেন, স্যার আমি আপনার কাছে এসেছি আমার স্ত্রীও জানে না।
অসংখ্য ঘটনার মধ্যে আজকে শুধু একজন রোগীর কথা বলব। মো: আ: জব্বার (ছদ্ম নাম), বয়স ৩৮, বাড়ি ছাগলনাইয়া, ফেনী, ওমানে চাকরি করেন। পাইলসের সমস্যা তীব্রতর হলে ২০০০ সালের অক্টোবরে দেশে আসেন এবং ঢাকার একটি বাসস্ট্যান্ডে পাইলস চিকিৎসা কেন্দ্র দেখে সেখানে যান। সেখানকার হাতুড়ে ডাক্তার তাকে অপারেশনের কথা বললে রোগী রাজি হন। অপারেশনের পর থেকে রোগীর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। অনবরত ব্যথা ও জ্বালাপোড়া। বিশেষ করে পায়খানা করার পর প্রচুর রক্ত যায় এবং মারাত্মক ব্যথা ও জ্বালাপোড়া করে। মাসখানেক পর দেখা যায় রোগী আর পায়খানা করতে পারছেন না। ধীরে ধীরে মলদ্বার সঙ্কুচিত হতে থাকে এবং রোগী ভাত, মাছ বাদ দিয়ে শুধু সরবত ও বার্লি খেয়ে জীবনযাপন শুরু করেন। এতেও পায়খানা করতে না পারলে রোগী আমার শরণাপন্ন হন। পরীক্ষা করে দেখি যে মলদ্বার এমন সরু হয়েছে যে শুধু একটি শলাকা বা বল পয়েন্ট কলমের মাথাটুকু প্রবেশ করে। রোগীর বক্তব্য তখন এরূপ ‘স্যার, পায়খানায় বসলে মলদ্বার দিয়ে কিছু বের হয় না, শধু চোখ দিয়ে পানি পড়ে।’ এমতাবস্থায় রোগী অন্যান্য অভিজ্ঞ সার্জনদেরও মতামত নেন। তাদের মতে এ ধরনের অপারেশন দেশে সম্ভব নয় বিধায় তারা সিঙ্গপুর যেতে পরামর্শ দিলেন। রোগী স্বচ্ছল না হওয়ায় অপারেশনের জন্য আমার শরণাপন্ন হন। রোগীকে আমরা প্রথমে পেটে কলোস্টমি ব্যাগ লাগিয়ে দেই যাতে মলদ্বার দিয়ে পায়খানা না যায়। এর পর দুই ধাপে মলদ্বারে প্লাস্টিক সার্জারি করে তার ধ্বংস হয়ে যাওয়া মলদ্বার নতুন করে পুনর্গঠন করি। এর পর তিনি স্বাভাবিকভাবে আবার মলত্যাগ করতে পেরে যেন নতুন জীবন ফিরে পেলেন। এত কিছুর পরও রোগীর ধারণা ছিল এই অপারেশনের ফলে হয়তো তার সাময়িক উন্নতি হয়েছে। দুই-এক মাস পর হয়তো তার মলদ্বার আবারো সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে অপারেশনের এক বছর অতিবাহিত হলে রোগীটি আবার আসেন এবং জানান যে তিনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। মলত্যাগে তার কোনোরূপ অসুবিধা নেই।
উল্লেখ্য, এ ধরনের অপারেশন বাংলাদেশ এই প্রথম। লেখক এ বিষয়ে এ বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভিজিটিং লেকচারার হিসেবে তার অপারেশনের সাফল্য উপস্থাপন করেন। লেকচারের শিরোনাম ছিল, ‘হাতুড়ে চিকিৎসার কারণে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাওয়া মলদ্বার পুনর্গঠনে জটিল অপারেশনের সাফল্য- বাংলাদেশে এ জাতীয় প্রথম অপারেশন।’ সম্মানিত রোগীদের প্রতি অনুরোধ আপনারা হাতুড়ে চিকিৎসা করে মলদ্বারের অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনবেন না। মলদ্বারের প্রতিটি রোগের চিকিৎসাবিজ্ঞানে সুষ্ঠু সমাধান রয়েছে। পাইলস রোগীদের ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে অপারেশন ছাড়া আমরা যন্ত্রের সাহায্যে সফলভাবে চিকিৎসা করছি। মলদ্বারের বিভিন্ন রোগের এবং পায়ুপথ ক্যান্সারের অত্যাধুনিক অপারেশন এখন দেশেই হচ্ছে। অতএব সম্মানিত রোগীদের এ জাতীয় চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। যারা এ জাতীয় সমস্যায় ভুগছেন এমন বিদেশী রোগীদেরও আমাদের দেশে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
অধ্যাপক ডা. এ কে এম ফজলুল হক