ইনদোরের এক লোক তার স্ত্রীর যৌনাঙ্গে তালা লাগিয়ে রেখেছিল আজ চার বছর। স্ত্রী অতিষ্ঠ হয়ে বিষ খেয়ে মরতে যাচ্ছিল, তড়িঘড়ি তাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করার সময় ধরা পড়লো তার যৌনাঙ্গ তালা বন্ধ। এই ঘটনাটি না ঘটলে কেউ জানতে পারতো না যে এই একবিংশ শতাব্দীতে আক্ষরিক অর্থেই যৌনাঙ্গ তালা বন্ধ করা হচ্ছে। যৌনাঙ্গের দুই অংশে সত্যিকার ছিদ্র করে ওতে তালার নল-অংশটা ঢুকিয়ে সত্যিকার চাবি দিয়ে তালা বন্ধ করে রাখা হচ্ছে প্রতিদিন। চাবি স্বামীর জিম্মায়। অন্য কোনও পুরুষাঙ্গ যেন ওই যৌনাঙ্গে প্রবেশ করতে না পারে সে কারণেই এই তালা চাবির আয়োজন। স্বামীর প্রয়োজনে স্বামী স্ত্রীর যৌনাঙ্গের তালা খোলে।
এই খবরটা যখন পড়ি, আমার মনে পড়ছিল অন্ধকার যুগে ইওরোপের মেয়েদের শরীরে লোহার তৈরি সতীত্ব-বন্ধনী বা চেস্টিটি বেল্ট লাগানো হত। দূর-দূরান্তে যাওয়ার আগে স্ত্রীদের যৌনাঙ্গে ভারী চেস্টিটি বেল্ট নামক লোহার খাঁচা পরিয়ে যেত স্বামীরা। স্ত্রীরা ওই লোহার খাঁচা খুলতে পারতো না যতক্ষণ না স্বামী এসে ওটির তালা না খোলে। স্ত্রীর যৌনাঙ্গের মালিক স্ত্রীরা নয়, মালিক স্বামী। তারা ছিল পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি যে যেভাবে পারে রক্ষা করে। যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা সেই অন্ধকার যুগে মেয়েদের যৌনাঙ্গে তালা লাগাতো, সেই একই মানসিকতা নিয়ে ইনদোরএর লোক তার স্ত্রীর যৌনাঙ্গে তালা লাগিয়েছে। সেই যুগ এবং এই যুগের মাঝখানে বেশ কিছু শতাব্দী পার হয়েছে, কিন্তু মানসিকতার কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। ঘটনা জানার পর লোকটিকে লোকে ছিছি করেছে, মাথা-খারাপ, বদমাশ ইত্যাদি বলে গালি দিয়েছে। অনেকে স্তম্ভিত, কারণ এরকম ঘটনা এ যুগে ঘটে না। তা ঠিক, সত্যিকার তালা লাগানোর ঘটনা ঘটে না, কিন্তু যে মানসিকতা তালা লাগায়, সেই মানসিকতাই সবার চারপাশে, সেই মানসিকতার লোকই আজকের সমাজ চালাচ্ছে। আসলে, তালা দৃশ্যমান হলেই লোকের আপত্তি। অদৃশ্য তালাতে কিন্তু কারও আপত্তি নেই।
নারী শুধু তার স্বামীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, পুরো সমাজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। নারী বিয়ের আগে কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করবে কি না, বিয়ের পর কার সঙ্গে কিভাবে চলবে, কত রাত অবধি বাইরে থাকবে, কাদের সঙ্গে মিশবে, কাদের সঙ্গে মিশবে না, কার সঙ্গে হাসবে, কার সঙ্গে হাসবে না, বাড়িতে কে কে আসবে, কে কে আসবে না, কার সঙ্গে শোবে, কার সঙ্গে শোবে না, এগুলো শুধু স্বামী বা পরিবার নয়, পুরো সমাজই বলে দেয়, আঙুল তুলে শাসিয়ে যায়। নারীর পান থেকে চুন খসলে চারদিকে অস্ত্র হাতে সৈন্যরা দাঁড়িয়ে থাকে হয় পাথর ছুড়ে মেরে ফেলার জন্য, নয়তো একঘরে করার জন্য, নয়তো ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য।
অদৃশ্য তালা সমাজের প্রতিটি মেয়ের যৌনাঙ্গে। যে মানসিকতা সতীত্ব বন্ধনী বা দৃশ্যমান তালা পরাতে মেয়েদের বাধ্য করতো, সেই মানসিকতাই আজ অদৃশ্য তালা পরাতে বাধ্য করে। তালা দেখা যায় না, কিন্তু তালা আছে। এই অদৃশ্য তালা যদি সমাজের কোনও মেয়ের যৌনাঙ্গে না থাকে, তাহলেই বরং তুলকালাম কাণ্ড ঘটে। সেই মেয়েকে সমাজে কেউ মেনে নেয় না যদি যৌনাঙ্গের অদৃশ্য তালাটি যথাস্থানে লাগানো না থাকে। এই অদৃশ্য তালার নাম পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্র। পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্রের খাঁচায় নারীরা বন্দী, পারিবারিক এবং সামাজিক শেকলে নারী বন্দী, তার জন্য তাই আলাদা করে লোহার খাঁচা বা লোহার তালা বানাতে হয় না।
পুরুষতন্ত্রের খাঁচা বাহ্যিক লোহার খাঁচা বা তালা বা শেকলের চেয়ে অনেক বেশি মজবুত, অনেক বেশি শক্তিশালী। লোহার খাঁচা ভাঙা সহজ, পুরুষতন্ত্রের শেকল ভাঙা অনেক কঠিন। এই পুরুষতন্ত্রে পুরুষের ভূমিকা হল, প্রভু, কর্তা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক, ভোগ করার মালিক। মেয়েদের ভূমিকা হল, পুরুষের দাসী, পুরুষের যৌনবস্তু আর পুরুষের সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। এটাই মূল ভূমিকা, নানারকম কায়দা কানুন করে, রং চং লাগিয়ে একে দেখতে ভিন্ন করা হয় বটে, কিন্তু যারা জানে, তারা জানে কাঠামোটাই দাঁড়িয়ে আছে বৈষম্যের ওপর। কাঠামোতেই যদি গলদ থাকে, তাহলে তার ওপর টাওয়ার বানানো হলে সেই টাওয়ারে ফাঁকি থাকে। ফাঁকি দিয়ে জীবন যাপন করা হচ্ছে। যার সঙ্গে সারাজীবন বাস করছো, তার সঙ্গেই প্রতারণা?
পৃথিবীতে অন্য কোনও প্রজাতি কি আছে যে নিজের প্রজাতিকে শুধু যৌনাঙ্গ ভিন্ন হওয়ার কারণে তাকে ঠকিয়ে, প্রতারিত করে, তার মানবাধিকার আর স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে নিজে মজা লোটে, সুখ করে? শুধু সে মেয়ে বলে? মূলে সমস্যা আর আমরা চাই বাইরেরটা গোছাতে, ওপরটা সুন্দর করতে, ওপরকে ঝকঝকে করতে। তাতে আসলে কাজ হয় না বলে আজও নারীর বিরুদ্ধে একটি বৈষম্যরও বিলুপ্ত হয়নি। এখনও মেয়েরা যৌন দাসী, এখনও মেয়েরা যৌন পাচারের শিকার, এখনও গৃহহিংসা, অনার কিলিং, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, কন্যা-শিশু হত্যা, কন্যা-ভ্রুণ হত্যা, এসিড নিক্ষেপ, যৌতুক প্রথার শিকার। পণ দিতে অক্ষম হলে ঘরে ঘরে বধু পোড়ানো, বধু হত্যা চলছে- নারী বিরোধী কোনও নৃশংসতাই বিলুপ্ত হয়নি সমাজ থেকে।
অনেকে বলে নারী শিক্ষিত হলেই নাকি নারীর সমস্যা ঘুচে যাবে। কিন্তু দেখা গেছে, শিক্ষিত নারী পুরুষতন্ত্রের নিয়মাবলি যত ভালোভাবে শিখতে পারে, তত ভালোভাবে অশিক্ষিত নারী পারে না। শেখার ক্ষমতা শিক্ষিতদের বেশি। শিক্ষিত মেয়েদের বিয়ে হলে ঠিক ঠিক তো বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে। অশিক্ষিত, দরিদ্র মেয়েরা যেমন যায়। নিজের নামের পদবী ফেলে দিয়ে স্বামীর পদবী লুফে নিচ্ছে শিক্ষিত নারীরা। ছেলেমেয়েদের জন্য পিতার পদবী, মায়ের নয়। এর অর্থ, মহিলা এবং তার সন্তানেরা পুরুষ স্বামীর অধীনস্ত। মহিলা এবং তার সন্তানের মালিক পুরুষটি। পিতৃতান্ত্রিক নিয়মে একটি মেয়েকে থাকতে হবে শিশুকালে তার পিতার অধীনে, বিয়ের পর স্বামীর অধীনে, আর বৃদ্ধ বয়সে পুত্রের অধীনে। শাস্ত্রেও এ কথা লেখা আছে। ন স্ত্রী সাতন্ত্রমর্হতি, স্বাধীনতায় নারীর কোনও অধিকার নেই।
নারীকে পুরুষতান্ত্রিক নিয়ম অনুযায়ী সারাজীবন পুরুষের অধীনে থাকতে হবে। তার নিজস্বতা স্বকীয়তা বলে কিছু থাকতে পারবে না। এই হল সমাজের নিয়ম, এই নিয়মটাকে অক্ষত রেখে নারীর জন্য লেখাপড়া শেখা আর কাজ করে টাকা রোজগার করাটা মেনে নেওয়া হয়েছে ইদানিং, কিন্তু সমাজের পুরুষতন্ত্রের কাঠামোতে কোনো রকম পরিবর্তন আনতে দেওয়া হয়নি। মেয়েদের কাপড় চোপড় পাল্টেছে, একবার তারা নিজেদের আপদমস্তক কাপড়ে ঢেকে রাখতে বাধ্য হচ্ছে, আরেকবার বাধ্য হচ্ছে সব খুলে ফেলতে। তারা সেক্সুয়াল অবজেকটিফিকেশনের শিকার, সবখানে। তারা কসমেটিকস মাখছে, কারণ পুরুষতান্ত্রিক জগত মেয়েদের মুহুর্মুহু উপদেশ দিচ্ছে পুরুষের চোখে আকর্ষণীয় হতে, আকর্ষণীয় হওয়ার জন্য শরীরের মাপ কী হওয়া চাই, বুক কত, কোমর কত, নিতম্ব কত, সব বলে দেওয়া আছে, কালো আর বাদামী রংএর মেয়েদেরও বলে দেওয়া হয়েছে, তোমার রংটা খারাপ, যত সাদা হতে পারবে, তত তোমার আকর্ষণ বাড়বে।
নারীকে পুরুষতান্ত্রিক নিয়ম অনুযায়ী সারাজীবন পুরুষের অধীনে থাকতে হবে। তার নিজস্বতা স্বকীয়তা বলে কিছু থাকতে পারবে না। এই হল সমাজের নিয়ম, এই নিয়মটাকে অক্ষত রেখে নারীর জন্য লেখাপড়া শেখা আর কাজ করে টাকা রোজগার করাটা মেনে নেওয়া হয়েছে ইদানিং, কিন্তু সমাজের পুরুষতন্ত্রের কাঠামোতে কোনো রকম পরিবর্তন আনতে দেওয়া হয়নি। মেয়েদের কাপড় চোপড় পাল্টেছে, একবার তারা নিজেদের আপদমস্তক কাপড়ে ঢেকে রাখতে বাধ্য হচ্ছে, আরেকবার বাধ্য হচ্ছে সব খুলে ফেলতে। তারা সেক্সুয়াল অবজেকটিফিকেশনের শিকার, সবখানে। তারা কসমেটিকস মাখছে, কারণ পুরুষতান্ত্রিক জগত মেয়েদের মুহুর্মুহু উপদেশ দিচ্ছে পুরুষের চোখে আকর্ষণীয় হতে, আকর্ষণীয় হওয়ার জন্য শরীরের মাপ কী হওয়া চাই, বুক কত, কোমর কত, নিতম্ব কত, সব বলে দেওয়া আছে, কালো আর বাদামী রংএর মেয়েদেরও বলে দেওয়া হয়েছে, তোমার রংটা খারাপ, যত সাদা হতে পারবে, তত তোমার আকর্ষণ বাড়বে।
ত্বকের জন্য খারাপ এমন কেমিক্যালে বাজার ছেয়ে গেছে, ত্বকের রং উজ্জ্বল করার জন্য, ত্বকের ভাঁজ বন্ধ করার জন্য। মেয়েরা এক তাল মাংস আর মুখ-বুক-যৌনাঙ্গ ছাড়া আর কিছু না। মেয়েদের যে মস্তিষ্ক আছে, ওতে যে বুদ্ধি ধরে, তা কখনও ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয় না। মেয়েরা হল পণ্য। পণ্যদের সাজতে হয়, ঝলমলে ঝকমকে হয়ে থাকতে হয়। সেভাবেই রাখা হয় মেয়েদের। কুমারীত্ব বজায় রাখতে হবে, পুরুষতন্ত্রের কঠিন নিয়ম। সব পুরুষই আকাঙ্ক্ষা করে কুমারী মেয়ে। একবার কারও সঙ্গে কোনও মেয়ের যৌন সম্পর্ক হয়েছে, এ খবর প্রচার হলেও পুরুষেরা আর বিয়ে করতে ইচ্ছুক হয় না সেই মেয়েকে। আর বিয়ের পর বজায় রাখতে হবে সতীত্ব। এই নিয়মটিই তো যৌনাঙ্গে শেকল বা তালা পরানোর নিয়ম। নারীর যৌনাঙ্গ নয় শুধু, নারীর জরায়ুর মালিকও পুরুষ। পুরুষ বা স্বামী সিদ্ধান্ত নেয় কটা সন্তান একটা মহিলা গর্ভে ধারণ করবে, এবং কোন লিঙ্গের সন্তান সে জন্ম দেবে।
যৌনাঙ্গ নিজের, অথচ নিজের যৌনাঙ্গের ওপরও কোনও অধিকার নেই মেয়েদের। পুরুষের যৌনাঙ্গে কোনও তালা লাগানোর নিয়ম নেই। পুরুষের জন্য বরং সারা পৃথিবীতেই খোলা হয়েছে পতিতালয়, পুরুষ যখন খুশি যৌনইচ্ছা চরিতার্থ করতে পারে। কোটি কোটি মেয়েকে ছলে বলে কৌশলে এই সমাজ পতিতা বা যৌন দাসী বানায় পুরুষ যেন তাদের ভোগ করতে পারে, পুরুষের স্ত্রী থাকুক বা না থাকুক সে কোনও বিষয় নয়।
একসময় পুরুষরাই ঘরের বাইরে যেত, লেখাপড়া করতো, মেয়েদের সে অধিকার ছিল না। একসময় শিক্ষিত পুরুষরাই বলল, মেয়েদের লেখাপড়া করা উচিত। উনবিংশ শতাব্দীতে শিক্ষিত পুরুষেরা আসলে কামনা করেছিলেন, শিক্ষিত যৌনসঙ্গীর। তাদের আশা পূরণ হয়েছে। মেয়েরা লেখাপড়া শিখেছে, বিদুষী হয়েছে। বিয়ের বাজারে শিক্ষিত মেয়ে ভালো বিকোয়। তবে শিক্ষিত হোক, অশিক্ষিত হোক, প্রায় সব পুরুষই পণ দাবি করে। শিক্ষিত এবং ধনী হলে পণ আকাশ ছোঁয়া। নারী-শিক্ষা নারী নির্যাতন ঘোচাবে, নারীর বিরুদ্ধে যে বৈষম্য, তা সব ঘোচাবে, এ বিশ্বাসযোগ্য কথা নয়। ইস্কুল কলেজ পাশ করলেই কেউ শিক্ষিত হয় না। বেশির ভাগ মানুষ লেখাপড়া শেখে পরীক্ষায় পাশ করার জন্য, আর ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য। সচেতন হওয়ার জন্য যে শিক্ষা, সত্যিকার আলোকিত মানুষ হওয়ার জন্য যে শিক্ষা, সে শিক্ষা অন্য শিক্ষা। আমরা যদি একটা সুস্থ সুন্দর সমাজ চাই, তবে মনে রাখতে হবে সেই সমাজে নারীর সমানাধিকার থাকতে হবে। নারী ও পুুরুষের সম্পর্ক প্রভু ও দাসীর সম্পর্ক নয়, সম্পর্কে বন্ধুতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি থাকতে হবে। সমাজের তৈরি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা বিলুপ্ত করতে হবে। কিন্তু কজন বাবা-মা কজন সন্তানকে এই শিক্ষা দিচ্ছে যে নারী আর পুরুষের অধিকার সমান।
পুরুষের শরীর পেশিবহুল, কিন্তু আমরা সমাজ, বা রাষ্ট্র বা পরিবার পেশির জোর দিয়ে চালাই না, আমরা বুদ্ধি দিয়ে চালাই। বুদ্ধি নারী ও পুরুষের কারওর কারও চেয়ে কম নয়। নারী প্রমাণ করেছে, যে কাজগুলোকে এতকাল পুরুষের কাজ বলা হত, সেই সব কাজ নারী করতে সমর্থ। (অবশ্য এখনও পুরুষ প্রমাণ দেয়নি নারী যে কাজে পারদর্শী, বা যেসব গুণ তাদের আছে সেসব কাজে পুরুষও পারদর্শী। সেসব গুণ তাদেরও আছে, যেমন বাচ্চা লালন পালন, সংসারের রান্না বান্না ঘরদোর পরিষ্কার, সহানুভূতিশীল হওয়া, নরম নম্র হওয়া, কোমল হৃদয়ের হওয়া ইত্যাদি।)
পিতৃতন্ত্র পুরুষ দ্বারা তৈরি পুরুষের আরাম আয়েস করার জন্য, প্রভুত্ব কায়েম করার জন্য একটি ব্যবস্থা। কিন্তু নারীর সাহায্য ছাড়া পিতৃতন্ত্র টিকে থাকতো না। নারীই পিতৃতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য পুরুষকে সব রকম সাহায্য করছে। যেমন আফ্রিকায় মেয়েদের যৌনাঙ্গের অংশ অল্প বয়সেই কেটে ফেলা হয়, মেয়েরা যেন যৌন সুখ কোনওদিন অনুভব করতে না পারে। অনেকের যৌনাঙ্গে আবার শেলাই করেও দেওয়া হয়। অনেক মহিলাই এই কাজটা করেন। মেয়ে হয়ে নিজ হাতে মেয়েদের পঙ্গু করেন। শুধু আফ্রিকা নয়, ভারতের বহরা মুসলিমদের মধ্যেও ফিমেল জেনিটাল মিউটিলিশান করার প্রচলন আছে। এশিয়ায় ইন্দোনেশিয়াসহ আরও কিছু দেশে হচ্ছে। যৌন পাচার তো চলছেই, যৌন দাসত্ব বা পতিতাবৃত্তি চলছে, মহিলারাও মহিলাদের বিরুদ্ধে জঘন্য এই নারী পাচারে সহায়তা করছে। মহিলারা পিতৃতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে চান, কারণ তাদের মাথায় এই বিশ্বাস ছোটবেলাতেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে পুরুষ হচ্ছে বড় জাতের মানুষ, নারী হচ্ছে ছোট জাতের মানুষ।
নারী হচ্ছে পুরুষের ভোগের সামগ্রী। এ ছাড়া অন্য কোনও পরিচয় নারীর নেই। এই জঘন্য নারীবিরোধী কুৎসিত মন্ত্র পুরুষের মাথাতেও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। পিতৃতান্ত্রিক নিয়মই নারীরা মাথা পেতে বরণ করে নিয়েছে, এই নিয়মই বশংবদ ভৃত্যের মতো পালন করছে, নারীকে অবমাননা করার, পণ্য হিসেবে ব্যবহার করার সব রকম প্রবাদ উচ্চারণ নারীই করছে, সব রকম ধর্মীয় সামাজিক নারীবিরোধী অনুশাসন অনুষ্ঠান মহাসমারোহে পালন করছে। শিক্ষিত স্বনির্ভর নারীরাও এতে অংশগ্রহণ করছে। তারা করছে কারণ নারীর শিক্ষা আর স্বনির্ভরতা অর্জন করার মানে তারা কখনও মনে করে না যে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। নারীরা শিক্ষা আর স্বনির্ভরতা অর্জন করছে পিতৃতন্ত্রের গণ্ডির মধ্যে বাস করে এবং শিক্ষা ও স্বনির্ভরতাকে ব্যবহার করছে নারীর স্বকীয়তা বিনাশে এবং পুরুষের স্বার্থে, পুরুষতন্ত্রের বিকাশে।
নারীর তথাকথিত এই শিক্ষা আর স্বনির্ভরতা বেশির ভাগই নারীর নিজের যত উপকারে লাগছে, পুরুষের লাগছে বেশি। পুরুষরা এখন শিক্ষিত স্ত্রী পাশে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে, পুরুষের পুত্ররা শিক্ষিত স্ত্রীর কাছে লালিত পালিত হচ্ছে, স্ত্রীর উপার্জিত অর্থ স্বামীর পকেটেই বেশির ভাগ যাচ্ছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক এখনও পুরুষরাই। নারীর উপার্জিত টাকা নারী কি খাতে ব্যয় করবে, সেই সিদ্ধান্তটি বেশির ভাগ নারীই নেয় না, নেয় পুরুষ। নারীর উপার্জিত টাকা নারীর যৌনাঙ্গের মত, বা জরায়ুর মতো অনেকটা। নারীর যৌনাঙ্গ কী খাতে ব্যবহার হবে, জরায়ু কী জন্য ব্যবহার হবে, কখন ব্যবহার হবে, কার দ্বারা ব্যবহার হবে, সেই সিদ্ধান্ত যার জরায়ু সে নেয় না, পুরুষ নেয়। অনেক স্বাধীনতাই মেয়েরা পাচ্ছে, রাস্তায় যাওয়ার, ইস্কুল কলেজে যাওয়ার, অফিস আদালতে যাওয়ার, কিন্তু যৌন-স্বাধীনতা এখনও পাচ্ছে না। কারণ ওই বন্দিত্বই নারীর সত্যিকার বন্দিত্ব। পুরুষতন্ত্র নারীর যৌনাঙ্গকে খুঁটি দিয়ে বাঁধে। যৌন স্বাধীনতার মানে কিন্তু কখনও যার তার সঙ্গে শুয়ে বেড়ানো নয়। যৌন স্বাধীনতার মানে নিজের পছন্দ মতো মানুষের সঙ্গে শোয়া, এবং শোয়ায় সবসময় হ্যাঁ নয়, না বলাটাও যৌন স্বাধীনতা। যৌন সম্পর্কে রাজি হওয়াই যৌন স্বাধীনতা নয়, রাজি না হওয়াও যৌন স্বাধীনতা।
মোদ্দাকথা হল, যৌনাঙ্গ-বন্দিত্ব, যৌন পরাধীনতা, গৃহ হিংস্রতা, কন্যাভ্রুণ হত্যা, শিশুকন্যা হত্যা, পণ, বধুহত্যা, যৌন দাসত্ব বা পতিতাবৃত্তি, নারী ও শিশু পাচার, ধর্ষণ ইত্যাদি রোগ নয়, এসব হল রোগের উপসর্গ। রোগের নাম পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্র। এদিকে আমরা উপসর্গ সারাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, রোগ সারাতে নয়। রোগ না সারালে উপসর্গ কোনওদিন বিলুপ্ত হবে না, যত চেষ্টাই করি না কেন।
সুত্রে- ওয়েবসাইড