মঙ্গলবার, জুলাই ০১, ২০১৪

ম্যারাডোনাকে ছাপিয়ে শুরু তারপর...

আর্জেন্টিনার নকআউট রাউন্ডের স্ক্রিপটা কেমন হবে? সেটা দলগত হলে একরকম আর মেসিময় হলে আরেক রকম। তবে দলগত পারফরম্যান্স চেয়ে ঝুঁকিতে পড়ার চেয়ে মেসি-ম্যাজিকের প্রার্থনা করাটাই আর্জেন্টাইন সমর্থকদের জন্য বুদ্ধিমানের।
দলগতভাবে আর্জেন্টিনা এখনো কিছুই করেনি এই বিশ্বকাপে। করলেও কতটা করার ক্ষমতা আছে, সেটা অজানা। বরং পরীক্ষিত এবং প্রমাণিত সত্য হলো, লিওনেল মেসির জাদুকরী ক্ষমতা। প্রতিটি ম্যাচেই গোল করেছেন এবং ম্যাচের গুরুত্বের বিচারে এসব গোল মহার্ঘ। তিন ম্যাচে আর্জেন্টিনা করেছে ছয় গোল, তার মধ্যে একটি আত্মঘাতী, অন্যটি রোহোর এবং বাকি চারটি খুদে জাদুকরের। মূলত এ চার গোলেই আলবিসেলেস্তেরা গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ব্রাজিল বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে পা রেখেছে।
২৮ বছর আগের আর্জেন্টিনার দিকে একটু ফিরে তাকাই। মেক্সিকো বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে ম্যারাডোনার ট্যাগ লাগেনি দলের গায়ে। ইতালির সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র ম্যাচে ম্যারাডোনার একটি গোল। বুলগেরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাকি দুই ম্যাচে ভালদানোর দুই গোল এবং বুরুচাগা ও অস্কার রুগেরি একটি করে গোল করে জিতিয়েছেন আর্জেন্টিনাকে। দলগত শক্তির প্রদর্শনী বিচারে সেই দল অনেক এগিয়ে, অন্তত প্রথম রাউন্ড টপকাতে ম্যারাডোনাকে 'ফুটবল ঈশ্বর' হতে হয়নি। বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণে এই দলেও প্রতিভার ঘাটতি নেই, অপার সম্ভাবনায় বিজ্ঞাপিত হয়ে তারা বিশ্বকাপে এলেও শুরু থেকেই মেসি মুখাপেক্ষী। সতীর্থরা খেলছেন, চেষ্টা করছেন, দলগত পারফরম্যান্সের উৎকর্ষে উঠে মেসিনির্ভরতা গৌণ করার প্রয়াস চালিয়েও লাভ হয়নি। শেষ কথা ওই লিওনেল মেসির ম্যাজিক, তিনি চার গোলে করে সবার ব্যর্থতা ঢেকে আর্জেন্টিনাকে নিয়ে গেছেন দ্বিতীয় রাউন্ডে। ডিয়েগো ম্যারাডোনার যেখানে এক গোল মেসির সেখানে চার গোল। সুতরাং প্রথম রাউন্ডেই তো আর্জেন্টাইন কিংবদন্তিকে ৪-১ গোলে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছেন খুদে জাদুকর!
এই ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে হয়েছে তাঁর অনেক ব্যক্তিগত অর্জন এবং বিসর্জন। এর আগে দুই বিশ্বকাপ মিলিয়ে ছিল এক গোল, গোলের যে গেরো লেগেছিল সেটা খুলেছে। তাতে বার্সার এই ফরোয়ার্ড আক্ষরিক অর্থে আকাশি-সাদায় আদ্যন্ত আর্জেন্টাইন হয়ে উঠেছেন এবং বিসর্জন হলো নিন্দুকের 'কাতালান' অপবাদ। চারদিকে এখন প্রশংসার ফুলঝুরি। নাইজেরিয়া যখন 'অন্য গ্রহের ফুটবলারের' কাছে হারে তৃপ্তি খোঁজে তখন ২৪ বছর বয়সী আর্জেন্টাইন সতীর্থ রোহোর চোখও ধাঁধিয়ে যায়, 'পেছনে দাঁড়িয়ে তার খেলা দেখাটাও অসাধারণ অভিজ্ঞতা।' ২৭ বছর বয়সী আর্জেন্টাইন জাদুকরের নকআউট রাউন্ডের পরীক্ষা শুরু হচ্ছে আজ সুইজারল্যান্ডকে দিয়ে। ২০১২ সালে ইউরোপের এই দলের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে প্রথম হ্যাটট্রিক করেছিলেন তিনি। সুবাদে প্রেরণার অভাব নেই। কিন্তু নকআউট রাউন্ডের স্ক্রিপটা কী হবে? '৮৬ বিশ্বকাপের নকআউটে গিয়েই হয়েছিল ম্যারাডোনা বিস্ফোরণ, উরুগুয়ের বিপক্ষে পাসকুলি পার করে দেওয়ার পর ইংল্যান্ডের ম্যাচ ম্যারাডোনাময় ফুটবল ইতিহাসের একটি অংশ। ৫১ মিনিটে 'হ্যান্ড অব গডে'র গোলের মিনিট চারেক পরে শতাব্দীর সেরা গোলটি করে ২-১ গোলে ইংল্যান্ডকে বিদায় করে দিয়েছেন কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। সেমিফাইনালেও জোড়া গোলে বেলজিয়ামকে শেষ করে দিয়েছেন তিনি। পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালে তাঁর গোল নেই, তবে গোলের জাদুকরী পাস আছে। সব মিলিয়ে পাঁচ গোল এবং পাঁচটি গোল অ্যাসিস্ট করে আর্জেন্টিনাকে শিরোপা জিতিয়ে হয়েছেন আর্জেন্টাইনদের নয়নের মণি। এবং উত্তরসূরিদের জন্য হয়েছেন বিশ্বকাপ মডেল।
তাই গ্রেট ডিয়েগোর সঙ্গে নিজের তুলনা দেখলে মেসি বিরক্ত হন। বার্সেলোনার হয়ে ক্লাব ফুটবলের সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছেন, জিতেছেন সব কিছু। তার পরও চারবারের বিশ্বসেরার ফুটবল ক্যারিয়ার পূর্ণাঙ্গ হয় না বিশ্বকাপ ছাড়া। দেশের জার্সিতে এই অর্জন হলেই ম্যারাডোনাকে ছোঁয়া যায়। সেই পথে এক কদম এগিয়ে গেছেন লিও, গ্রুপের তিন ম্যাচে করা চারটি গোলের মধ্যে তিনটিই অসাধারণ গোল এবং তিনটিতেই আছে তাঁর পায়ের জাদুকরী সম্মোহন। ২৮ বছর আগে ম্যারাডোনা-ম্যাজিক নকআউট রাউন্ডে শুরু হলেও মেসিকে শুরু করতে হয়েছে প্রথম রাউন্ড থেকে। কারণ বাকি দশজনের পার্থিব ক্ষমতায় হচ্ছে না বলে। পরের চারটি ম্যাচের জন্য ফুটবল পণ্ডিতরা দলগত পারফরম্যান্সের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। দি মারিয়া-হিগুয়াইনরা ম্যাচ বের করে আনলে মেসির ওপর চাপ কমে। মেসি-নির্ভরতা কমে। তখন কেবল ওই একজনকে নিয়ে প্রতিপক্ষের চিন্তা থাকলে, তাঁকে আটকে দিলেও অন্যরা ম্যাচ বের করে নিতে পারবে। নেইমারের খেলা বন্ধ করে দিয়ে চিলি যেমন ব্রাজিলকে কানা করে দিয়েছে, সেই বিপদের কথাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এসব ট্যাকটিক্যাল ব্যাপার নিয়ে মাথায় জট পাকানোর দরকার নেই। তা ছাড়া নেইমার আর মেসি তো এক জিনিস নয়, এত কড়া প্রহরায় রেখেও ইরান পারেনি তাঁর পায়ের ম্যাজিক বন্ধ করতে। লা লিগা বা চ্যাম্পিয়নস লিগেও এমন প্রহরা বসিয়ে কাজ হয় না। তাই দি মারিয়ার আহ্বানে সাড়া দেওয়াটাই হবে বুদ্ধিমানের, 'আমাদের দলে মেসি আছে, এটা বড় পাওনা। সবাই মিলে তাকে সাহয্য করা উচিত।'
ম্যারাডোনা-ম্যাজিক শুরু হয়েছিল নকআউট পর্বে। 'খুদে জাদুকর' শুরু করেছেন তারও আগ থেকে। ১৯৮৬ আর ২০১৪-র পার্থক্য ২৮ বছরের কিন্তু যেভাবে শুরু করেছেন তাতে বাকিদের একটু সঙ্গ পেলে সময়ের এই বিশাল তফাত ঘুচিয়ে দেওয়া তাঁর কয়েক মুহূর্তের জাদুর ব্যাপার।