মঙ্গলবার, জুলাই ০১, ২০১৪

আলোচনা ছিল বাজেট নিয়ে কথা হলো বিএনপি নিয়ে!

জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় এবার রেকর্ডসংখ্যক সংসদ সদস্য অংশ নিয়েছেন। সরকার ও বিরোধী দলের ২৬১ জন সংসদ সদস্য আলোচনায় যোগ দিয়েছেন। আলোচনা হয়েছে ৬৩ ঘণ্টারও বেশি সময়। তবে বাজেট নিয়ে যতটা কথা হয়েছে এর চেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে সংসদের বাইরে থাকা দল বিএনপি নিয়ে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আলোচনায়ই আগ্রহী ছিলেন বেশির ভাগ সংসদ সদস্য। কটূক্তিও করেছেন অনেকে। এর মাধ্যমে সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির লঙ্ঘন হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ২৭০ ধারায় বলা হয়েছে, 'সংসদ সদস্যরা সংসদে বক্তৃতা দেওয়ার সময় কোনো আক্রমণাত্মক কটূক্তি বা অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করতে পারবেন না। দেশদ্রোহমূলক বা মানহানিকর উক্তি অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে সংসদের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য বক্তৃতা করা যাবে না। আদালতে বিচারাধীন কোনো বিষয় উল্লেখ করা যাবে না।' ২৬৭ ধারায় বলা হয়েছে, 'কোনো সংসদ সদস্য বক্তৃতার সময় কোনো ধরনের টিপ্পনী কাটা, শিস দেওয়া বা বিশৃঙ্খল আচরণ করে বাধা সৃষ্টি করা যাবে না।'
অথচ বাজেট আলোচনার প্রায় পুরো সময়ই সংসদ সদস্যরা ধারা দুটি লঙ্ঘন করে বক্তৃতা দিয়েছেন। প্রয়াত ও বর্তমান রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন। বিশেষ করে তাঁরা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি নেতাদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। এমনকি জিয়া পরিবারের জন্ম ইতিহাস নিয়েও অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ বক্তৃতা দিয়েছেন। এ তালিকায় ছিলেন সরকারি দলের নবীন থেকে শুরু করে প্রবীণ সদস্যরা। বিরোধী দলের অনেকে তাঁদের পথ অনুসরণ করেছেন। অবশ্য আলোচনা চলাকালে স্পিকার এ বিষয়ে সদস্যদের সতর্ক করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত ৩ জুন দশম সংসদের প্রথম বাজেট অধিবেশন শুরু হয়। ৫ জুন সংসদে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করা হয়। ২৯ জুন বাজেট পাস হয়। অধিবেশনের ১৬ কার্যদিবসে বাজেট আলোচনা চলেছে ৬৩ ঘণ্টা ছয় মিনিট। অংশ নিয়েছেন সরকারি দলের ২০৩ জন, বিরোধী দলের ৫৮ জন। এটা নতুন রেকর্ড। বাজেটের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য এবং সাবেক পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল তারেক রহমান। তিনি বলেন, 'তারেক জিয়া একটা অর্বাচীন। সে ইতিহাস বিকৃতি ঘটাচ্ছে।' জিয়া হত্যার পেছনে খালেদার যোগসাজশ রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, 'না হলে জিয়া হত্যার সময় তাঁর পাশের রুমে থাকা বদরুদ্দোজা চৌধুরীর দরজায় টোকাও পড়ল না কেন? খালেদা জিয়া তাঁকে পুরস্কৃত করার জন্য রাষ্ট্রপতি বানালেন কেন? বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, কিন্তু জিয়া হত্যার বিচারের উদ্যোগ নেননি। কারণ হলো, হত্যার সঙ্গে খালেদা জিয়া আর বদরুদ্দোজা চৌধুরী জড়িত ছিলেন। খালেদা জিয়া তাঁর স্বামীর কবর জিয়ারত করতে যান। কিন্তু সাজগোজের কমতি দেখি না। কারণ, উনি জানেন, ওই কবরে জিয়ার লাশ নেই।'
আওয়ামী লীগের শামসুল হক চৌধুরী বলেন, সাত সমুদ্র তের নদী দূরে বসে তারেক রহমান একের পর এক ইতিহাস বিকৃতি করছেন। নূরন্নবী চৌধুরী শাওন বলেন, লন্ডনে বসে মীমাংসিত বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির সাহস তারেক রহমান কোথায় পান? ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু কঠোর সমালোচনার পাশাপাশি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বাতিলের দাবি জানান।
বাজেট আলোচনায় সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের বেগম ফজিলাতুন্নেসা বলেন, খালেদা জিয়া বেসামাল হয়ে পড়েছেন। তিনি খালেদা জিয়ার জন্ম ইতিহাস বর্ণনার নামে আপত্তিকর বক্তৃতা করেন। একইভাবে জিয়া পরিবারের নামে কটূক্তি করেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নূরুল ইসলাম সুজন, মাহাবুব আরা গিনি ও সাবিনা আক্তার তুহিন।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হাবিব-এ-মিল্লাত বলেন, 'তারেক নাকি অসুস্থ। অসুস্থ হলে মালয়েশিয়ায় কীভাবে যান? বিদেশ ঘুরতে পারেন, কিন্তু দেশে আসার সাহস দেখাতে পারেন না। বাবা ম্যাট্রিক পাস করে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, মা পড়াশোনা না করেই প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তাই তারেক জিয়ার শখ, ম্যাট্রিক পাস করেই ব্যারিস্টারি সার্টিফিকেট নেওয়া। কিন্তু লন্ডনে এটা অসম্ভব।'
একইভাবে খালেদা জিয়া ও তাঁর দল বিএনপি নেতাদের কঠোর সমালোচনা করেন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও অন্য সংসদ সদস্যরা। জাতীয় পার্টির এমপি কাজী ফিরোজ রশীদ বিএনপির সমালোচনার পাশাপাশি সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রীকে তুলোধুনো করেন। জাপার আরেক সদস্য জিয়াউদ্দিন বাবলুও বিএনপি-জামায়াতের কঠোর সমালোচনা করেন।
কার্যপ্রণালী বিধি লঙ্ঘন করা সমীচীন নয় উল্লেখ করে ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, অতীতের যেকোনো সময়ের থেকে এবার বাজেট অধিবেশনে আলোচনা ভালো হয়েছে। সেখানে কেউ আপত্তিকর কোনো বক্তব্য দেওয়ার চেষ্টা করলে তাকে সতর্ক করা হয়েছে। বক্তৃতার সময় কার্যপ্রণালী বিধির ২৬৭ ও ২৭০ ধারার প্রতি খেয়াল রাখতে বলা হয়েছে। এর পরও কেউ আপত্তির কোনো আলোচনা করলে সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত।
চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ বলেন, সংসদে কাউকে কটূক্তি করে বা অশালীন বক্তব্য না দেওয়ার ব্যাপারে স্পিকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। স্পিকার আপত্তির সব শব্দই এক্সপাঞ্জ করেছেন। আগামী দিনে সব সদস্যই কার্যপ্রণালী বিধি মেনে বক্তৃতা করবেন বলে তিনি আশাবাদী।