সোমবার, জুলাই ১৪, ২০১৪

দেউলিয়া থেকে এখন মিলিয়নিয়ার

ব্রাজিল বিশ্বকাপে যেসব নতুন উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম ‘ম্যাজিক স্প্রে’ বা ‘ভ্যানিশিং স্প্রে’। ফ্রি-কিক নেয়ার সময় বল থেকে ১০ গজ দূরে খেলোয়াড়রা মানব দেয়াল তৈরি করেন। আর এর সীমা নির্ধারণ করতে রেফারি কোমর থেকে ভ্যানিশিং স্প্রে নিয়ে ব্যবহার করেন। ৬০ সেকেন্ড পর স্প্রের উপাদান মাটি থেকে উধাও হয়ে যায়। বিশ্বকাপে মানব দেয়াল তৈরির বিতর্ক এড়াতে এবারও এই ভ্যানিশং স্প্রে ব্যবহার করা হয়েছে। আর এর পেছনের কারিগর ব্রাজিলের গরিব ঘরের সন্তান হেইন আলেমাগনে। এক ভ্যানিশিং স্প্রে আবিষ্কার করে দেউলিয়া থেকে এখন মিলিয়নিয়ার হওয়ার পথে তিনি। বিশ্বকাপের পর আগামী মওসুম থেকে ইউরোপের বিভিন্ন লীগে এই স্প্রে ব্যবহারের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের কয়েকজন কোচ নাকি ইতিমধ্যে এই স্প্রে ব্যবহারের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। আর যদি তাই হয় তাহলে কপাল খুলে গেছে ব্রাজিলিয়ান স্প্রে আবিষ্কারক হেইনের। ইতিমধ্যে তিনি কামিয়েছেন অনেক টাকা। আর যদি ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে ব্যবহার শুরু হয় তাহলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা তার পায়ে এসে পড়বে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তার এই ফোম আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে চমৎকার গল্প। ব্রাজিলের অধিকাংশ বড় ফুটবলারদের বেড়ে ওঠার ইতিহাস রাস্তা থেকে। এই আবিষ্কারকের ইতিহাসও ঠিক একই রকম। ব্রাজিলের ছোট্ট শহর মিনাস গারাইসের ঘুপচি গলিতে বেড়ে উঠেছেন তিনি। বাবার পাঁচ সন্তানের একজন হেইন। ছোটবেলায় খাবার-দাবার ভালভাবে জোটেনি তার। মাত্র ৮ বছর বয়সেই কাজের সন্ধানে ছুটতে হয়। রাস্তায় রাস্তায় আইসক্রিম বিক্রি করেই জীবন নির্বাহ করতেন হেইন। প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তার হয়নি। ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই তাকে বড় হতে হয়েছে। এক সময় ছোটখাটো ব্যবসায় হাত দেন তিনি। কিন্তু দেউলিয়া হয়ে পথে নামতে হয় তাকে। তবে মাত্র ১৪ বছর বয়স থেকেই ফুটবলে এমন স্প্রে ব্যবহারের আইডিয়া উদয় হয় তার মনে। নিজের বাল্যকালের দরিদ্রতার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হেইন বলেন, ‘আমরা মিনাসের একটি ছোট্ট বাড়িতে বসবাস করতাম। বাবা-মা ও পাঁচ ভাইবোন মিলে তিনটি ছোট রুমে গাদাগাদি করে থাকতাম। ছোটবেলায় কোন খেলনা কোনদিন পাইনি। কাপড়-চোপড় ছিল না বললেই চলে। পেটের দায়ে বাবা আমাকে মাত্র ৮ বছর বয়সেই কাজের জন্য পাঠিয়ে দেন। রাস্তায় রাস্তায় আইসক্রিম বিক্রি করে জীবন চালাতাম।’ নিজের এ ভ্যানিশিং স্প্রে আবিষ্কার নিয়ে হেইন বলেন, ‘আমার বয়স তখন ১৪ বছর। আইসক্রিম বিক্রি করে একদিন বাড়ি এসে দেখি বাবা আমাদের পুরনো ভাঙাচোরা টিভিতে খেলা দেখছেন। কোন দলের খেলা মনে নেই। তবে ফ্রি-কিক নেয়ার সময় দুই দলের খেলোয়াড় ও রেফারির মধ্যে বিতর্কের কথা আমার মনে আছে। তখনই আমার এমন একটি স্প্রে আবিষ্কারের কথা মাথায় আসে। বাথরুমে গিয়ে সেভিং ফোম নিয়ে কয়েকবার নাড়াচাড়া করি। চিন্তা করি এটা ব্যবহার করলে কেমন হয়। কিন্তু পরে মনে হলো, না সেটা বাতাসে অল্প সময়ে মিশে যায় না। পরে চিন্তা করে সবজির রস ও অন্যান্য কিছু উপাদান দিয়ে এই স্প্রে আবিষ্কারের প্রথম পথ উন্মুক্ত করি। পরে এটাকে আরও উন্নত করে ফুটবল মাঠে ব্যবহারের উপযোগী করি।’
বিশ্বকাপে ভ্যানিশিং স্প্রে প্রথম ব্যবহার হলেও ব্রাজিলে এর ব্যবহার শুরু হয় ২০০০ সাল থেকে। এই স্প্রে আবিষ্কারের পর হেইন নিজে ব্রাজিলের ফেডারেশন কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে কথা বলেন। প্রথমে তারা এটাকে গ্রহণ করেননি। তবে পরে পরীক্ষামূলক ব্যবহারে রাজি হন তারা। ২০০০ সালে বেলো হরিজন্তের একটি টুর্নামেন্টে প্রথম এটা ব্যবহার করা হয়। সুফল পেয়ে তারা নিয়মিত এটা ব্যবহার করতে থাকেন। বিশ্বকাপের আগে ব্রাজিলের প্রায় ১৮,০০০ ম্যাচে ব্যবহার কার হয় এই স্প্রে। নিজের জীবনের গল্প বর্ণনা করতে গিয়ে হেইন বলেন, ‘ছোটবেলায় আমি ফুটবলার হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হতে পারিনি। খাবার চেয়েছিলাম, কিন্তু পাইনি। আমি চাই না আমার সন্তানরা অশিক্ষা ও অভুক্ত হয়ে বড় হোক।’ নিজের আবিষ্কৃত ভ্যানিশিং স্প্রে প্রথমে বিশ্বকাপে ব্যবহার হতে দেখে কেমন লেগেছি- এমন প্রশ্নের জবাবে হেইন বলেন, ‘বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই এটা ব্যবহার করা হয়। তখন বন্ধুরা আমাকে লাগাতার ফোন ও মেসেজ দিতে থাকে। আমি অভিভূত হয়ে পড়ি। মাত্র ১৪ বছর বয়সের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়ে দেখে আমি কেঁদে ফেলি। মনে মনে ভাবি, আমি পাগল নই- শুরুতে অনেকেই যেমনটা মনে করেছিল। আমি মূল্যবান একটি কাজ করেছি।’