ব্রাজিলিয়ান সমর্থক আর আর্জেন্টিনীয় ফুটবল সমর্থকদের মধ্যে সাধারণ ফারাকটা কোথায়? গত চার দিনে ব্রাজিলের চার শহরে দু'দফায় দুটো দেশের ফ্যানেদের মধ্যে ঘোরাঘুরি করে মনে হচ্ছে, ফ্যানেদের বিশ্বকাপ ফাইনাল হলে ট্রফিটা পাবেন আর্জেন্টিনীয়রাই৷ উগ্রতায়৷ পাগলামিতে৷ কণ্ঠের তীব্রতায়৷ আবেগে৷ গুন্ডামিতেও৷
ব্রাজিলের সমর্থকদের পাগলামিটার প্রকাশ একেবারে অন্যরকম৷ পাশ দিয়ে দুটো দলের সমর্থকরা হেঁটে গেলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে এদের মনোভাবের বিস্তর পার্থক্য৷ শরীরী ভাষাতেই আর্জেন্টিনা অনেক এগিয়ে থাকবে৷ শুনলাম, আর্জেন্টিনার জঙ্গি ফুটবল গোষ্ঠী 'বারাস ব্রাভাস'এর মতো পাল্টা জঙ্গি দল আছে ব্রাজিলেও৷ নাম অর্গানাইজাদাস৷ তারা আর্জেন্টিনীয়দের তুলনায় কোথাও থাকবেন না৷ তুলনায় ওরা রবীন্দ্র গীতিনাট্যে সখীর দল৷
ব্রাজিলের খেলা থাকলে দেশের বিভিন্ন শহরে ছুটির হাওয়া৷ রেস্তোরাঁয় ওয়েটারদের গায়ে ব্রাজিলের জার্সি৷ বাড়িতে খেলা দেখতে বসলেও জার্সি থাকবে অনেকের৷ টিম জিতলে পাড়ায় পাড়ায় বার্বিকিউ পার্টি৷
ব্রাসিলিয়াতেই আগের দিন যেমন টিম চার গোল দিল৷ ব্রাজিলিয়ানরা খুব শান্ত ভাবে স্টেডিয়ামে ঢুকলেন এবং ম্যাচ শেষে দ্রুত স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে গেলেন৷ পাশের ম্যাকডোনাল্ডসে বসে চুপচাপ খেয়ে বাড়ি৷ আর্জেন্টিনীয়রা এ জায়গায় হলে অনেক রাত পর্যন্ত স্টেডিয়ামের চারপাশ ঘুরবেন৷ স্টেডিয়ামের পুরো পরিবেশ শুষে নেবেন৷ ম্যাকডোনাল্ডসে গেলে সেখানেও চলবে নাচগান৷ উত্সবটা ব্রাজিলিয়ানদের মতো স্টেডিয়ামেই শেষ করে দেবেন না৷ তারা স্টেডিয়ামে ঢুকবেনও কয়েক মাইল দূর থেকে গান গাইতে গাইতে৷ সকাল থেকে রাত ফুটবল উৎসব৷
আর্জেন্টিনার খেলা থাকলে ব্রাজিলেই নীল-সাদা সমর্থকরা যে ভাবে রাত থেকে রাস্তায়, ভোরবেলা স্টেডিয়ামের সামনে, তাতে প্রশ্ন জাগছে, নিজের দেশে খেলা হলে কী হতো?
দলের ম্যাচ শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় লাতিন আমেরিকান সমর্থকরা যা করছেন, তা আগে কোনো বিশ্বকাপে দেখিনি৷ জাতীয় সঙ্গীত হচ্ছে রীতিমতো দু'দফায়৷ সরকারি ভাবে গানটা হওয়ার পরে সমর্থকদের দল আবার খোলা গলায় কিছুটা গাইছেন৷ ফুটবলারদের গাইতে বাধ্য করছেন৷ সাও পাওলোতে প্রথম ম্যাচে এই ব্যাপারটা শুরু করেছিল ব্রাজিল৷ আর আর্জেন্টিনা সেই ব্যাপারটা নিয়ে গিয়েছে অন্য উচ্চতায়৷ শেষ দিকটায় এদের গান শুনলে মনে হচ্ছে, এদের দেশ আক্রমণ করেছে কোন দেশ৷ তারা এ বার পাল্টা লড়াইয়ে বেরোবেন৷ গলার শিরা ছিঁড়ে ফেলবেন৷ পাশের লোকটাকে ঘুসি মেরে রক্তাক্ত করে দেবেন৷ এদের সঙ্গে একমাত্র তুলনা চলতে পারে চিলির সমর্থকদের উগ্রতার৷
ম্যাচ যখন চলছে, তখন ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া একেবারে আলাদা৷ আর্জেন্টিনার ফ্যানের দল সারাক্ষণ ধরে গান গেয়ে যান৷ কতরকম গান! ব্রাজিলিয়ানদের স্টকে মনে হয়, এত গান নেই৷ তারা নেইমারদের উদ্বুদ্ধ করতে অধিকাংশ সময় চেঁচান, 'ব্রাজিল, ব্রাজিল' বলে৷ নেইমারের নামেও ওই এক সুরে জয়ধ্বনি হলো মাঝেমাঝে৷ পাশাপাশি মেক্সিকান ঢেউ তৈরি হতে থাকল৷
বেলো অরিয়েন্তে বা রিও ডি জেনেরোতে মেসির দেশের সমর্থকরা কী করলেন? তারা জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার পরে ওই যে নানা রকম গান শুরু করলেন, তা থামল একেবারে ম্যাচের শেষে৷ এক একটা গ্যালারিতে এক রকম গান৷ ম্যারাডোনাকে মাঠের স্ক্রিনে দেখা মাত্র গান শুরু হল তাকে নিয়ে৷ তার পর সেই জায়গা থেকে চলে যাওয়া হল ব্রাজিলকে বিদ্রুপে৷ তোদের পেলের থেকে আমাদের ম্যারাডোনা ভালো৷ এক একটা গ্যালারিতে এক একটা গান৷ তার পরে হঠাৎ সবাই মিলে গেয়ে ওঠা, 'ওলে ওলে ওলে'৷ 'ওলে ওলে' চিৎকার আবার ব্রাজিলে নেই বললেই হয়৷ চিলিতে আছে৷
অবাক লাগল, পেলে-গারিঞ্চা থেকে শুরু করে রোনাল্ডো-রোনাল্দিনহো, এত এত মন কাড়া নাম ব্রাজিলে, অথচ জাতীয় দলের খেলার সময় তাদের নামে কোনো গান হয় না৷ ১৯৫৮ থেকে ১৯৭০ সালের বিশ্বজয়ের সময়ের ব্রাজিলিয়ান গানের উল্লেখ রয়েছে ব্রাজিলে৷ সে গুলো শোনা যায় না বেশি৷ এবার বিশ্বকাপের আগে খবর ছিল, পেলে বিশ্বকাপ নিয়ে গান লিখেছেন৷ সে সব কোথায়? কেউ তো উচ্চবাচ্য করল না৷ নেইমার এত ভালো খেলছেন৷ তাকে নিয়ে কোনো গান এখনও শুনলাম না৷
ম্যারাডোনার নামে এত গান আছে, পেলের নামে কেন ব্রাজিলের খেলার সময় গান হয় না? ব্রাসিলিয়ায় ব্রাজিলের সাংবাদিক রিকার্দো হাসলেন, 'আসলে আমাদের এত এত তারকা, কাকে ছেড়ে কাকে নিয়ে গান হবে? ওদের তো একটা নামই আছে৷'
মনে হয়, এটাই শুধু কারণ নয়৷ সামাজিক, আর্থ সামাজিক কোনো কারণ থাকবে৷ ব্রাজিলের বেস ক্যাম্প ও আর্জেন্টিনা বেসক্যাম্পের সামনের ছবিটা মাথায় রাখলে ফারাকটা বোঝা যাবে৷ রিও ডি জেনেরো থেকে শ খানেক কিলোমিটার দূরে তেরেসোপোলিস পাহাড়ের ওপর ব্রাজিলের শিবির৷ সেখানে গিয়ে রোমান্টিক ব্যাপার চোখে পড়বে৷ জাতীয় জার্সি সবার গায়ে৷ সেজেগুজে সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ এক তরুণী কুকুরকে জাতীয় দলের রংয়ের জার্সি পরিয়ে বসে আছেন৷ এক জন একটা পাখির ডানা লাগিয়েছেন পিছনে৷ কিন্ত্ত দেখে বোঝা যাচ্ছে, কেউ এখানে থাকবেন না৷ সামান্য পরে চলে যাবেন৷ যতক্ষণ ব্রাজিল ফুটবলাররা প্র্যাক্টিসে থাকবেন, তাদের মেলা মেলা ব্যাপারটা থাকবে৷ চিৎকার বেশি নেই৷ অন্তহীন প্রতীক্ষা আছে৷
আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের শিবিরের মানে মেলা নয়, যুদ্ধের পরিবেশ৷ সেখানে তাবু ফেলে বসে আছেন এক দল লোক৷ কারও গাড়িতেই রান্নার গ্যাস থেকে বাথরুমের উপকরণ৷ তারা এখানেই থাকবেন পুরো রাত৷ গাড়িতে পুরোনো সব জার্সি লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবেন শহর৷ জাতীয় শিবিরের সামনে যে তারকারা এসে কথা বলেন, তা নয়৷ কিছুই হয় না৷ সামনে দিয়ে মেসিদের বাস বেরিয়ে যায়৷ তবু এরা পড়ে থাকবেন৷ ম্যাচের আগের রাতে প্রায়ান্ধকারে স্টেডিয়ামের বাইরে ঘুরে বেড়াবেন, কোথায় টিকিট পাওয়া যায়৷ ম্যাচের সময় এরা মাঝেমাঝে কাগজের টুকরো ফেলেন৷ এই জায়গায় ব্রাজিলের ভক্তরা একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন৷
দুটো দলের সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলে এমন একটা তথ্য জানলাম, তাতে মনে হয়, আর্জেন্টিনার ফুটবল ভাবনাটা অনেক ইউরোপিয়ান৷ ও দেশে যত ছোটই ক্লাব হোক না কেন, ইউরোপের মতো ছোট ছোট ক্লাবেরও আছেন অনেক গোঁড়া সমর্থক৷ যারা প্রাণ দিয়ে দেবেন ছোট ক্লাবের জন্য৷ ব্রাজিলে ফ্লামেঙ্গো, ফ্লুমিনেসি, বোতাফোগো, কোরিন্থিয়ান্স, সাও পাওলো, আতলেতিকো মিনেইরো, ক্রুজেইরোর মতো বড় ক্লাবগুলোর বেশি রমরমা৷ তাদেরই বেশি সমর্থক৷ ছোট ক্লাবের অত গোঁড়া সমর্থক নেই৷ সম্ভবত এ কারণেই আর্জেন্টিনা ঘরোয়া লিগে অনেক বেশি ঝামেলা লেগেই থাকে৷
এ সব পড়ার পরে এবার কল্পনা করে নেওয়ার পালা, মারাকানায় ফাইনালে দুটো দেশের দেখা হলে ম্যাচের আগের ও পরের দৃশ্যগুলো কী দাঁড়াবে৷
( সংগ্রহীত )