আঁধার কেটে যাচ্ছে ক্রমশ। একটু একটু করে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে মাত্র। রাস্তায় বাড়ছে মানুষের সংখ্যা। রাতভর জেগে থাকা কুকুরগুলোও অলস হাই তুলছে। হেডলাইট নিভিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে গাবতলীর লোকাল বাস। ঠিক তখনই গলির ভেতর থেকে মুখ গুঁজে বেরিয়েছেন কয়েকজন। কেউ যুবতী, কেউ মাঝবয়েসী। তবে গার্মেন্টসকর্মী নয় কেউই। কাজের সন্ধানেও বেরুয়নি তারা। রাতভর নিজেকে বিক্রি করে এখন ঘরে ফেরার পালা।
রাজধানীর পুরানা পল্টনের পানির ট্যাংকি গলির মুখে দেখা ওদের সঙ্গে। ভোরের মানুষ দেখে খানিকটা ইতস্তত। ভালো মতো মুখ ঢাকতেও ভোলেনি দু’একজন। কাছে যেতেই গলার আওয়াজ নামিয়ে এনেছে একদম নীচে। যেন নিজেদের কোনো কিছুই প্রকাশ করতে আগ্রহী নয় আর।
পিছু নিতেই জোরসে ধমকে উঠলো একজন, ‘ওই কী চাস? এহন আর না। দূরে যা।’ ধমক মনে হলেও এরমধ্যে ছিলো একরাশ ক্ষোভ। নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পারার তীব্র প্রতিবাদও ছিল এটি। খানিকটা পথ হেঁটেই উল্টো দৌড় দিলো সবাই। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল পুলিশের টহল গাড়ি। পুলিশকে যেন যমের মতো ভয় পায় ওরা সবাই।
প্রায় ১০ মিনিট পরে গলি ছেড়ে আবার বেরুলো সবাই। পুলিশকে না দেখে রাস্তার একপাশেই বসলো দুইজন। খানিকটা ক্লান্ত। একটু যেন গা এলিয়ে দিতে পারলেই শান্তি। পাশে গিয়ে বসতেই প্রশ্ন ছুঁড়লো, ‘পুলিশডি কোনদিগে গেল?’ চলে গেছে জেনে এবার যেনো নিশ্চিন্ত হলো। ক্যান, পুলিশে কী সমস্যা? পাল্টা প্রশ্ন করতেই সব ঝাড়লো একসঙ্গে। একজন বলে উঠলো, ‘আরে জানেন না। মাইরা কিচ্ছু রাখে না। লাঠি দিয়া পিডাইয়া সব ফাডাইয়া দেয়।’ বলেই পায়ের কাপড় সরিয়ে দেখালো অন্যজন। আঁতকে ওঠার মতো দৃশ্য। বাম পায়ের হাঁটুর নীচে লাল হয়ে ফুলে গেছে একটি অংশ। মোটা হয়ে বসে গেছে লাঠির আঘাত।
তারপর এক এক করে ঝাড়তে লাগলো রাতভর জমে থাকা ক্ষোভগুলো। ‘পুলিশের লাইগা কিচ্ছু করন যায় না। এমনিতেই বৃষ্টি। তারপরেও পুলিশ আইয়া শান্তি দেয় না। খালি ট্যাকা দিলেই সব ঠিক।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন।
নাম জানতে চাইলে এবার আর কোনো আড়ষ্টতা নয়। ঝটপট বললেন, ‘লাকি’। বাড়ি কই, প্রশ্ন করতেই সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘নরসিংদীর ঘোড়াশালে’। তারপর নিজ থেকেই বললেন লাকি, ‘পেটের দায়ে ইজ্জত বেচি। রাস্তায় নামছি। শখে না। কোন কিছুর বাছ বিছার করি না। মানুষ খারাপ কয়। শরম লাগে। তবুও এইসব করি। খালি কয়ডা খাওনের লাইগা, পোলাপাইনডিরে মানুষ করনের লাইগা। তারপরেও এতো কষ্ট আর সহ্য হয় না।’
সঙ্গে থাকা মাকসুদা তখনই কথা বলে উঠলেন, ‘আল্লাহ হেগো বিচার করবো। আমরা তো কারও ক্ষতি করি না। ক্ষতি যা, তা তো নিজেরই করছি। নিজেরে শেষ কইরা দিছি। আর কিচ্ছু বাকি রাখি নাই। তবুও আমাগোরো শান্তি দেয় না।’
লাকী আর মাকসুদার জীবনগল্প মোটেও সুখকর নয়। নামে লাকি হলেও জীবনগড়া তার দুঃখ দিয়েই। নরসিংদীর এ মেয়ে বড় হয়েছেন ভুলতা গাউছিয়ায়। আর্থিক টানাপোড়েনের সংসারে পড়াশোনার ঝাপি খুব একটা খুলতে পারেননি। বইখাতা গুটিয়ে ফেলতে হয়েছে ক্লাস ফাইভে ওঠার আগেই। বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে বয়স হওয়ার আগে। বাবার অভাবী সংসারে নিয়ম মতো খাবার না জুটলেও ভেবেছিলেন স্বামীর সংসারে হয়তো সেটা আর থাকবে না। কিন্তু কষ্ট পিছু ছাড়েনি। মাত্র আটমাস টিকেছে সে সংসার। তারপর রিকশাচালক স্বামী আরও একজন বউ তুলে এনেছেন ঘরে। ততোদিনে লাকির পেটে নতুন মুখের কোলাহল।
শুরু হলো নতুন যন্ত্রণা। নিত্য মারধর, গালাগাল। সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন লাকি। প্রতিবাদে নেমে এসেছেন রাস্তায়, বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেকে। গত সাতবছর ধরে এভাবেই চালাচ্ছেন নিজেকে। তার সন্তান লিমনের বয়সও এখন সাত বছর।
মাকসুদার গল্পেও ভিন্নতা নেই খুব একটা। বয়সে লাকির চেয়ে চার পাঁচ বছরের বড়। তার সন্তান দুজন। বড় মেয়ের ক্লাস ফোরে পড়ে আর ছোট ছেলে এখন স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। স্বামীর খবর জানতে চাইলে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে মাকসুদা। তারপর গড়গড় করে বলেন, ‘পৃথিবীতে আমার দুই সন্তান ছাড়া আর কেউ নাই। স্বামী আছে তার অন্য সংসার লইয়া। আমার লগে গত ১০ বছর ধইরা কোন যোগাযোগ নাই।’
এমন গল্প শুনে প্রশ্ন করতে মুখ কাঁপে। তবুও জানতে ইচ্ছে করে অনেক কিছু। হয়তো বুঝতে পেরে নিজ থেকেই মাকসুদা বললেন, ‘আমাগোরে মানুষ খারাপ কয়। আমরা খারাপ কাম করি। কিন্তু কেউ তো ভালো করবো কইয়া একটা কাম দেয় না। উল্টা পারে না ঝাঁটা দিয়া পিটাইয়া বিদায় করে। হেইল্লাইগা আমরা এহানে আইয়া এইসব করি। বাড়িতে যাওনের আগে বোরখা পইরা একদম ঠিকঠাক হইয়া যাই। কেউ কোনদিন টেরও পায় না আমরা কী করি। সবাই জানে হসপিটালে আয়ার কাম করি।’
কথার ফাঁকে আলো ফুটে উঠেছে পুরোপুরি। ফেরার তাগাদা অনুভব করেছে লাকিরা। উঠে দাঁড়ালেন দুজনেই। আবার ভালো করে মুখ ঢেকে নিলেন দুজনেই। তাদের সঙ্গে তখন রাতভর আয় করা কয়েকশ টাকা আর নিজেকে বিকিয়ে দেয়ার রাশি রাশি কষ্ট। ‘ভাই গেলাম। রাইতে আইসেন, সব কমু। অহন যাই, বাচ্চার ঘুম ভাইঙ্গা না পাইলে কাইন্দা দিবো। আমগোরে রাইতেই পাইবেন, দিনে না…।’
লাকি আর মাকসুদা দ্রুত পা চালালেন। যাওয়ার আগে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন, আঁধারেই তাদের জীবন, তাদের রাত কখনোই ভোর হয় না।