বৃহস্পতিবার, জুলাই ১৭, ২০১৪

এ পথ আওয়ামী লীগের নয়

ঘটনাটি বিস্ময়কর। তবে অভাবনীয় নয়। ক্রিকেটে এমন অঘটন নিয়মিতই ঘটে। ফুটবলে কখনও কখনও। কয়েকদিন আগে কর্মীর অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সভা পণ্ড হয়ে যাওয়া তো বিস্ময়করই। কবে কোথায় কে ভেবেছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী দলের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটবে। অথচ আওয়ামী লীগই কিনা ক্ষমতায় রয়েছে টানা সাড়ে পাঁচ বছর। প্রবল-প্রমত্ত দলটি হারিয়ে গেছে সরকারের ভেতরে। দুনিয়াবি কারবারে ব্যস্ত নেতা-কর্মীরা। প্রত্যেকেই চেষ্টায় আছেন আখের গোছাতে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল। দৃশ্য একই। শুধু আওয়ামী লীগ নয় সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরাও এখন ব্যস্ত টেন্ডারবাজি আর ব্যবসা-বাণিজ্যে। ছাত্রলীগের কারণে বারবার বিব্রত হতে হয়েছে সরকারকে। ছাত্রসংগঠনটি এখন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আত্মঘাতী সংঘাতে লিপ্ত। যদিও এই দুর্বল দল নিয়ে প্রবল প্রতাপেই ক্ষমতায় টিকে আছে আওয়ামী লীগ। তবে নীতিনির্ধারকরা যে চিন্তিত নন তা নয়। কারণ তারাও জানেন, যদি কখনও ঝড় আসে তবে এই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সে ঝড় সামলাতে পারবেন না। অথচ অতীতে শত বিপর্যয়ের মুখেও আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলো ছিল সক্রিয়। দিনের পর দিন সংগঠনের জন্য কাজ করে গেছেন নেতাকর্মীরা। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে অনিশ্চয়তা ছিল, উদ্বেগও ছিল। আওয়ামী লীগেরই একটি বড় অংশ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত রাজকৌশলেরই জয় হয়। এর জন্য নির্বিচারে ব্যবহার করা হয় পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবিসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে দিনের পর দিন পরিচালনা করা হয় যৌথ বাহিনীর অভিযান। রীতিমতো পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয় দেশ। ‘অভিনব’ পদ্ধতিতে ক্ষমতায় আসার পর সরকারকে অবশ্য অভ্যন্তরীণভাবে তেমন কোন চাপ মোকাবিলা করতে হয়নি। গুম-মামলা-কারাগারের ভয়ে চুপসে যায় বিএনপি-জামায়াত। যদিও সরকারের সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতার গুঞ্জন রয়েছে। হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সমঝোতার বিষয়টি অবশ্য এখন একেবারেই স্পষ্ট। তবে ঈদের পর আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছেন ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তার এ ঘোষণাকে প্রকাশ্য সরকার তেমন গুরুত্ব না দিলেও ভেতরে ভেতরে এক ধরনের উৎকণ্ঠা রয়েছে। কারণ সরকারের উপর থেকে আন্তর্জাতিক চাপ এখনও কমেনি। যদিও কৌশলে এ চাপ মোকাবিলা করে যাচ্ছে সরকার। দশম সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই একটি নতুন অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচনের জন্য পশ্চিমা বিশ্ব চাপ দিয়ে আসছে। এমনকি ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা জুনেই একটি নতুন নির্বাচনের কথা বলেছিলেন। সর্বশেষ জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও সরকারকে সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। তবে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ভারতীয় সরকার ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে তার বন্ধু সরকারের জন্য সম্ভাব্য সব কিছুই করেছে। বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্যও কাজ করে ভারত। তাদের ওই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও বাংলাদেশের ভারতের অবস্থানের জয় হয়। তবে দিল্লির মসনদে পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি দেখা যায়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের বাংলাদেশ সফরের পর আওয়ামী লীগের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি দেখা গেলেও অস্বস্তি পুরো কাটেনি। বিশেষ করে কংগ্রেস সরকারের মতো সমর্থন পাওয়া নিয়ে পুরোমাত্রাই সন্দিহান সরকারি নীতিনির্ধারকরা। এক্ষেত্রে বিরোধী দলের আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক চাপ একসঙ্গে সামলানো হবে সরকারের জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী কতটুকু সক্রিয় থাকে সেদিকেও দৃষ্টি রয়েছে সরকারের। যদিও পূর্বমুখী নীতিতে শেখ হাসিনা সরকার আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলার চেষ্টা করছে। এরই অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন ও জাপান সফর করেন। জাপান বাংলাদেশকে বড় অংকের আর্থিক সহযোগিতার ঘোষণা দিলেও এ ব্যাপারে কিছু শর্ত রয়েছে। বিরোধী শক্তি ও আন্তর্জাতিক চাপের বাইরেও নিজ সমর্থনপুষ্ট প্রগতিশীল মহল থেকেও সরকার যে কোন সময় চাপের মুখে পড়তে পারে। কারণ জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধের বিচারে এক ধরনের শিথিলতা দেখা যাচ্ছে। কেউ বলছেন সমঝোতা, কেউ বলছেন সরকারি কৌশল। তবে জামায়াতের সঙ্গে সরকারের সমঝোতাকে আত্মঘাতী হবে বলেই মনে করেন আওয়ামী লীগ সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা। যদি শেষ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতার কোন প্রমাণ স্পষ্ট হয় সেক্ষেত্রে গণজাগরণ মঞ্চসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে পরিচিত অংশের আন্দোলনও মোকাবিলা করতে হতে পারে সরকারকে। অন্যদিকে, প্রকাশ্য আন্দোলন ও চাপের বাইরে সরকারের বিরুদ্ধে এক ধরনের ষড়যন্ত্র এখনও সক্রিয় বলে মনে করেন সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরাই। কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ও সরকারের বিরুদ্ধে এখনও ষড়যন্ত্র চলছে বলে মন্তব্য করেন। গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য আওয়ামী লীগের ত্যাগের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। গায়েবি ভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সেই ঐতিহ্য বহুলাংশেই ক্ষুণ্ন হয়েছে। বিস্ময়কর হলেও সত্য, আওয়ামী লীগেরও কেউ কেউ একটি নতুন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে রয়েছেন। যদিও তাদের কেউ প্রকাশ্য নন। কারণ এখনও পর্যন্ত সব কিছুই সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কোথাও টু-শব্দটিও নেই। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, এ নিয়ন্ত্রণ ক্ষণস্থায়ী। যে কোন সময়ই বদলে যেতে পারে দৃশ্যপট।