১৯৯০ সালে স্বৈরশাসকের পতন এবং ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথমবারের মতো নিরপেক্ষ প্রশাসনের অধীনে সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরে দেশ-বিদেশের বাংলাদেশীরা দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উৎসাহিত ও আস্থায় বলিয়ান হলেন। দুই দশকের বেশি সময় পরে সেই একই বাংলাদেশীরা মনোবলহীন ও বিষণ্ন হয়ে পড়েছেন। যে প্রশ্ন অনবরত উঠছে, চার দশক আগে বেদনার মধ্য দিয়ে যার জন্ম, যাদের পিতা-প্রপিতামহগণ সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে ছিনিয়ে
এনেছিলেন, তাদের প্রিয় স্বদেশের ভাগ্যে কি ঘটবে? এখান থেকে বাংলাদেশ কোথায় যাবে?
সবুজ ধানক্ষেত বেষ্টিত একটি ছোট বদ্বীপে সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের বাস। তার উর্বর ভূমির বুক চিরে বয়ে গেছে নদীমালা। এই ভূখ-কেই সপ্তম শতাব্দীতে হিউয়েন সাং ও চতুর্থ শতাব্দীতে ইবনে বতুতার মতো বিখ্যাত পর্যটকদের আকৃষ্ট করেছিল। অঢেল তার ভূমি। ১৭৫৭ সালে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাকে যখন উপনিবেশ করেছিল তখন এটি ছিল সমৃদ্ধতম। ১৯৪৭ সালে বৃটিশরা যখন ছেড়ে গেল তখন এ অঞ্চলটি ছিল বিশ্বের অন্যতম দারিদ্র্যপীড়িত। যদিও বাংলাদেশ সত্তর দশকের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে, এখনও তাকে আর বহু দূর যেতে হবে।
বাংলাদেশকে নিয়ে গল্পটা চার্লস ডিকেন্সের ‘আ টেল অব টু সিটিজ’কে স্মরণ করিয়ে দেয়। ‘এটা শ্রেষ্ঠতম সময়, এটা নিকৃষ্টতম সময়,... এটা আশাবাদের ঝর্ণা, এটা কষ্টে কাটানো শীতকাল।’ বাংলাদেশ তার নিরাশার নিকৃষ্ট শীতকাল পেরিয়ে এসেছে। এবং এখন তার নিকৃষ্ট সময় অতিক্রম করছে। বাংলাদেশ যদি ডুবতে থাকে তাহলে সে ডুবছে তার রুগ্ণ রাজনীতির কারণে, আর সেটা ক্যানসারের মতো তাকে কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে। তবে তার এই রোগ নিরাময়ের অযোগ্য নয়।
বাংলাদেশ একটি সমগোত্রীয় সমাজ। তার কোন উপদলীয় বিভেদ নেই। আমাদের জাতিগত সংখ্যালঘু আছে। কিন্তু জাতিগত উত্তেজনা নেই। আমাদের রাজনীতি বিভেদ সৃষ্টিকারী। আর এই বিভাজনের রাজনীতিই আমাদের দেশকে বিভক্ত করছে। সমাজকে পার্টি লাইনে বিভক্ত করতে বাধ্য করছে। এখন সামজিক ঐক্য বলতে এর প্রায় সবটাই হারিয়ে গেছে। এবং এটা একটা ট্র্যাজেডি।
এ ঘটনার মূল কারণ হলো ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে কখনও কোন কার্যকর সংলাপ হয়নি। বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যেতে হলে আমাদের দরকার সম্প্রীতি। আর এটা কখনও অর্জন করা যাবে না, যদি আমরা অন্যের মতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাদের ভিন্নমত ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে না পারি। চলমান বাংলাদেশে সমঝোতার বিষয়টি মনে হয় আকাশকুসুম। কিন্তু এটা তো অন্যান্য দেশ জয় করেছে, তাহলে বাংলাদেশ কেন পারবে না?
আমরা এমন একটি দেশে বাস করি যেখানে সংঘাত খুবই স্বাভাবিক প্রবণতা। কিন্তু আপস খুবই বিরল ঘটনা। একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ দেশ গঠনের জন্য আমাদের উচিত সংলাপ ও সমঝোতার সংস্কৃতি চালু করা। সমঝোতাকে কাপুরুষোচিত মনে করা উচিত নয়। বাস্তবে কোন সঙ্কট থেকে জাতিকে বাঁচাতে এটা হতে পারে বীরোচিত। ম্যান্ডেলার প্রজ্ঞা ও সমঝোতায় তার অভিপ্রায় ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকায় রক্ত স্নান ঘটত। তিউনেসিয়া, যেখানে ‘আরব বসন্ত’ শুরু হয়েছে, সেটা এর অতি সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নজিরবিহীন। এখনকার মতো এত বেশি অজবাবদিহি কখনও দেখা যায়নি। এমনকি ঔপনিবেশিক আমলেও নয়। ১৯১৯ সালে জেনারেল দাইয়ারকে জালিওয়ানালাবাগ হত্যাকা-ের জন্য হাউজ অব কমন্সের সামনে অপ্রতুলভাবে হলেও জবাবদিহি করা হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জ ও ফেনির মতো আরও যেসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটেছে তার হত্যাকারীদের কি জবাবদিহির আওতায় আনা হবে? সময় তা বলবে। কিন্তু জনগণ সন্দেহগ্রস্ত রয়ে যবে। যেভাবে ক্ষমতাসীনরা নিজকে ক্ষমতায় এনেছে এবং যে কায়দায় তারা এখন দেশ চালাচ্ছে সেটা অন্তত কম করেও বলতে হয় সেই রাজনৈতিক আন্দোলনের মর্যাদার চেয়ে অনেক নিচে, যারা আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল। আওয়ামী লীগ বর্তমানে যেসব কারণ দেখিয়ে ক্ষমতায় রয়েছে তার সবটাই ভ্রান্তিকর।
আরেকটি কথা বলতেই হয়, একটি জাতি হিসেবে আমরা মর্যাদা হারানোর হুমকির মধ্যে আছি। ভারতের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে যেভাবে সেদেশের নতুন সরকারের বাংলাদেশের প্রতি সম্ভাব্য মনোভাব কি হবে সেটা নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনা চলেছে তাতে একেবারেই কোন মর্যাদার প্রতিফলন ঘটেনি।
ভারত একটি বড় দেশ। এবং সমগ্র ইতিহাস জুড়ে এটাই দেখা গেছে যে, একটি বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে বসবাসরত ক্ষুদ্র প্রতিবেশীকে অনেক প্রতিকূলতা সইতে হয়। সে কারণে এতে বিস্ময় সামান্যই আছে যে, ভারতকে ঘিরে বাংলাদেশের অনেক উদ্বেগ রয়েছে। এটা অনস্বীকার্য যে, ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অসন্তোষ রয়েছে, ভারতভীতি আছে, ভারত সম্পর্কে ভুল বেঝাবুঝিও আছে। অপরদিকে ভারত সীমান্ত ‘সন্ত্রাস’ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এ সবই বাস্তবতা। এটা সত্য যে, ভারতকে চটানোর সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। কিন্তু বাংলাদেশ অবশ্যই কার্যকরতা ও মর্যাদার সঙ্গে ভারতকে মোকাবিলা করতে পারে। কিন্তু কেবল সেটা যদি বুদ্ধিমত্তা ও দ্বিদলীয় নীতির ভিত্তিতে পরিচালনা করা সম্ভব হয়ে থাকে। দলের পরিচয় নির্বিশেষে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সকল বাংলাদেশীকে প্রভাবিত করে থাকে। সম্ভবত এখানেই দলগুলোর মধ্যে প্রকৃত সহযোগিতার সম্পর্ক শুরু হতে পারে। এ ধরনের একটি উদ্যোগ গ্রহণ অপিরিহার্য। কারণ বাংলাদেশের ভারতকে প্রয়োজন এবং ভারতের বাংলাদেশকে প্রয়োজন।
বাংলাদেশ সকল বাংলাদেশীর জন্য। জনগণ এবং রাজনীতিবিদ, তা তারা ডান, বাম, মধ্যডান বা মধ্যবাম কিংবা তারা যতই ইসলামী, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, সমাজতন্ত্রী সবাই একটি বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। সেটা জাতির সার্বভৌমত্ব ও অখ-তা রক্ষা, গণতন্ত্র সুরক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ, বিএনপি বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টি বাংলাদেশ, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ হতে পারে না। বাংলাদেশ একটি হবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, যেখানে সাড়ে ১৬ কোটি বাংলাদেশীর সকলের ঠিকানা।
আমাদের সংবিধান শুরু হয়েছে ‘আমরা জনগণ’ দিয়ে। এখন একে ‘আমি, রাষ্ট্র’ পরিণত করার যে কোন কার্যকর চেষ্টা হবে আত্মঘাতী। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পরবর্তী দশকগুলোতে বাংলাদেশ রাজনৈতিক অস্থিতির অশুভ বৃত্ত থেকে বেরোতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও তা সত্ত্বেও সে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
বিধাতা বাংলাদেশকে মেধাবী তরুণদের একটি শক্তিশালী বাহিনী দিয়েছে। এর মধ্যে বিদেশে বাংলাদেশী সম্প্রদায়ও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কিন্তু তারা রাজনীতি নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছে। এই হতাশার বহিঃপ্রকাশ একটি বিরাট ক্ষতি। এরা যাতে এখন বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় প্রণোদিত হয় সেই চেষ্টা করতে হবে। একটি মহান জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর যে গর্ব সে বিষয়ে তাকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এবং বিভক্তির রজনীতি যা দিয়ে আজকের শাসন চলছে সেই পথে তাদের হৃদয়কে হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না।
একটি সম্মানজনক ও সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশের প্রত্যাবর্তন ঘটানো সম্ভব, যেখানে সে এক সময় ছিল। সব কিছুই হারিয়ে যায়নি।
লেখক: ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। অনলাইন মিডিয়া উইথ কনসায়েন্স (এমডব্লিউসি ডট কম)-এ প্রকাশিত লেখার অনুবাদ।
এনেছিলেন, তাদের প্রিয় স্বদেশের ভাগ্যে কি ঘটবে? এখান থেকে বাংলাদেশ কোথায় যাবে?
সবুজ ধানক্ষেত বেষ্টিত একটি ছোট বদ্বীপে সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের বাস। তার উর্বর ভূমির বুক চিরে বয়ে গেছে নদীমালা। এই ভূখ-কেই সপ্তম শতাব্দীতে হিউয়েন সাং ও চতুর্থ শতাব্দীতে ইবনে বতুতার মতো বিখ্যাত পর্যটকদের আকৃষ্ট করেছিল। অঢেল তার ভূমি। ১৭৫৭ সালে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাকে যখন উপনিবেশ করেছিল তখন এটি ছিল সমৃদ্ধতম। ১৯৪৭ সালে বৃটিশরা যখন ছেড়ে গেল তখন এ অঞ্চলটি ছিল বিশ্বের অন্যতম দারিদ্র্যপীড়িত। যদিও বাংলাদেশ সত্তর দশকের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে, এখনও তাকে আর বহু দূর যেতে হবে।
বাংলাদেশকে নিয়ে গল্পটা চার্লস ডিকেন্সের ‘আ টেল অব টু সিটিজ’কে স্মরণ করিয়ে দেয়। ‘এটা শ্রেষ্ঠতম সময়, এটা নিকৃষ্টতম সময়,... এটা আশাবাদের ঝর্ণা, এটা কষ্টে কাটানো শীতকাল।’ বাংলাদেশ তার নিরাশার নিকৃষ্ট শীতকাল পেরিয়ে এসেছে। এবং এখন তার নিকৃষ্ট সময় অতিক্রম করছে। বাংলাদেশ যদি ডুবতে থাকে তাহলে সে ডুবছে তার রুগ্ণ রাজনীতির কারণে, আর সেটা ক্যানসারের মতো তাকে কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে। তবে তার এই রোগ নিরাময়ের অযোগ্য নয়।
বাংলাদেশ একটি সমগোত্রীয় সমাজ। তার কোন উপদলীয় বিভেদ নেই। আমাদের জাতিগত সংখ্যালঘু আছে। কিন্তু জাতিগত উত্তেজনা নেই। আমাদের রাজনীতি বিভেদ সৃষ্টিকারী। আর এই বিভাজনের রাজনীতিই আমাদের দেশকে বিভক্ত করছে। সমাজকে পার্টি লাইনে বিভক্ত করতে বাধ্য করছে। এখন সামজিক ঐক্য বলতে এর প্রায় সবটাই হারিয়ে গেছে। এবং এটা একটা ট্র্যাজেডি।
এ ঘটনার মূল কারণ হলো ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে কখনও কোন কার্যকর সংলাপ হয়নি। বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যেতে হলে আমাদের দরকার সম্প্রীতি। আর এটা কখনও অর্জন করা যাবে না, যদি আমরা অন্যের মতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাদের ভিন্নমত ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে না পারি। চলমান বাংলাদেশে সমঝোতার বিষয়টি মনে হয় আকাশকুসুম। কিন্তু এটা তো অন্যান্য দেশ জয় করেছে, তাহলে বাংলাদেশ কেন পারবে না?
আমরা এমন একটি দেশে বাস করি যেখানে সংঘাত খুবই স্বাভাবিক প্রবণতা। কিন্তু আপস খুবই বিরল ঘটনা। একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ দেশ গঠনের জন্য আমাদের উচিত সংলাপ ও সমঝোতার সংস্কৃতি চালু করা। সমঝোতাকে কাপুরুষোচিত মনে করা উচিত নয়। বাস্তবে কোন সঙ্কট থেকে জাতিকে বাঁচাতে এটা হতে পারে বীরোচিত। ম্যান্ডেলার প্রজ্ঞা ও সমঝোতায় তার অভিপ্রায় ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকায় রক্ত স্নান ঘটত। তিউনেসিয়া, যেখানে ‘আরব বসন্ত’ শুরু হয়েছে, সেটা এর অতি সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নজিরবিহীন। এখনকার মতো এত বেশি অজবাবদিহি কখনও দেখা যায়নি। এমনকি ঔপনিবেশিক আমলেও নয়। ১৯১৯ সালে জেনারেল দাইয়ারকে জালিওয়ানালাবাগ হত্যাকা-ের জন্য হাউজ অব কমন্সের সামনে অপ্রতুলভাবে হলেও জবাবদিহি করা হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জ ও ফেনির মতো আরও যেসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটেছে তার হত্যাকারীদের কি জবাবদিহির আওতায় আনা হবে? সময় তা বলবে। কিন্তু জনগণ সন্দেহগ্রস্ত রয়ে যবে। যেভাবে ক্ষমতাসীনরা নিজকে ক্ষমতায় এনেছে এবং যে কায়দায় তারা এখন দেশ চালাচ্ছে সেটা অন্তত কম করেও বলতে হয় সেই রাজনৈতিক আন্দোলনের মর্যাদার চেয়ে অনেক নিচে, যারা আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল। আওয়ামী লীগ বর্তমানে যেসব কারণ দেখিয়ে ক্ষমতায় রয়েছে তার সবটাই ভ্রান্তিকর।
আরেকটি কথা বলতেই হয়, একটি জাতি হিসেবে আমরা মর্যাদা হারানোর হুমকির মধ্যে আছি। ভারতের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে যেভাবে সেদেশের নতুন সরকারের বাংলাদেশের প্রতি সম্ভাব্য মনোভাব কি হবে সেটা নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনা চলেছে তাতে একেবারেই কোন মর্যাদার প্রতিফলন ঘটেনি।
ভারত একটি বড় দেশ। এবং সমগ্র ইতিহাস জুড়ে এটাই দেখা গেছে যে, একটি বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে বসবাসরত ক্ষুদ্র প্রতিবেশীকে অনেক প্রতিকূলতা সইতে হয়। সে কারণে এতে বিস্ময় সামান্যই আছে যে, ভারতকে ঘিরে বাংলাদেশের অনেক উদ্বেগ রয়েছে। এটা অনস্বীকার্য যে, ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অসন্তোষ রয়েছে, ভারতভীতি আছে, ভারত সম্পর্কে ভুল বেঝাবুঝিও আছে। অপরদিকে ভারত সীমান্ত ‘সন্ত্রাস’ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এ সবই বাস্তবতা। এটা সত্য যে, ভারতকে চটানোর সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। কিন্তু বাংলাদেশ অবশ্যই কার্যকরতা ও মর্যাদার সঙ্গে ভারতকে মোকাবিলা করতে পারে। কিন্তু কেবল সেটা যদি বুদ্ধিমত্তা ও দ্বিদলীয় নীতির ভিত্তিতে পরিচালনা করা সম্ভব হয়ে থাকে। দলের পরিচয় নির্বিশেষে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সকল বাংলাদেশীকে প্রভাবিত করে থাকে। সম্ভবত এখানেই দলগুলোর মধ্যে প্রকৃত সহযোগিতার সম্পর্ক শুরু হতে পারে। এ ধরনের একটি উদ্যোগ গ্রহণ অপিরিহার্য। কারণ বাংলাদেশের ভারতকে প্রয়োজন এবং ভারতের বাংলাদেশকে প্রয়োজন।
বাংলাদেশ সকল বাংলাদেশীর জন্য। জনগণ এবং রাজনীতিবিদ, তা তারা ডান, বাম, মধ্যডান বা মধ্যবাম কিংবা তারা যতই ইসলামী, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, সমাজতন্ত্রী সবাই একটি বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। সেটা জাতির সার্বভৌমত্ব ও অখ-তা রক্ষা, গণতন্ত্র সুরক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ, বিএনপি বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টি বাংলাদেশ, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ হতে পারে না। বাংলাদেশ একটি হবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, যেখানে সাড়ে ১৬ কোটি বাংলাদেশীর সকলের ঠিকানা।
আমাদের সংবিধান শুরু হয়েছে ‘আমরা জনগণ’ দিয়ে। এখন একে ‘আমি, রাষ্ট্র’ পরিণত করার যে কোন কার্যকর চেষ্টা হবে আত্মঘাতী। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পরবর্তী দশকগুলোতে বাংলাদেশ রাজনৈতিক অস্থিতির অশুভ বৃত্ত থেকে বেরোতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও তা সত্ত্বেও সে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
বিধাতা বাংলাদেশকে মেধাবী তরুণদের একটি শক্তিশালী বাহিনী দিয়েছে। এর মধ্যে বিদেশে বাংলাদেশী সম্প্রদায়ও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কিন্তু তারা রাজনীতি নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছে। এই হতাশার বহিঃপ্রকাশ একটি বিরাট ক্ষতি। এরা যাতে এখন বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় প্রণোদিত হয় সেই চেষ্টা করতে হবে। একটি মহান জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর যে গর্ব সে বিষয়ে তাকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এবং বিভক্তির রজনীতি যা দিয়ে আজকের শাসন চলছে সেই পথে তাদের হৃদয়কে হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না।
একটি সম্মানজনক ও সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশের প্রত্যাবর্তন ঘটানো সম্ভব, যেখানে সে এক সময় ছিল। সব কিছুই হারিয়ে যায়নি।
লেখক: ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। অনলাইন মিডিয়া উইথ কনসায়েন্স (এমডব্লিউসি ডট কম)-এ প্রকাশিত লেখার অনুবাদ।