শনিবার, জুলাই ০৫, ২০১৪

কলেজছাত্রীর ‘বহুপ্রেম’, প্রাণ গেল প্রহরীর

একাধিক ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল কলেজছাত্রী ফাতেমা-তুজ-জোহরার (১৯)। ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষক, এক ব্যবসায়ী ও দুই সহপাঠী ছিল তার প্রেমিকের তালিকায়। শেষ পর্যন্ত অন্য প্রেমিকদের ফাঁকি দিয়ে বেছে নিয়েছিলেন একজনকে। নিজের ও পরিবারের পছন্দে ক্যামব্রিয়ান কলেজেরই শিক্ষক মাহফুজুল হকের সঙ্গে আংটি বদল হয় তার। অন্যদের কেউ কেউ বিষয়টি মানতে পারেনি। তাই অপহরণ করে নিয়ে যায় ফাতেমাকে। অপহরণকারীদের হাত থেকে ফাতেমাকে বাঁচাতে গিয়ে বলি হন লিয়াকত হোসেন লিটন (৩৮) নামে এক নিরাপত্তাকর্মী। অপহরণকারীরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। কুপিয়ে আহত করে হবু বর মাহফুজুল হককেও (২৭)। বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় রাজধানীর উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর রোডের ৬ নম্বর বাড়ির সামনে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পরপরই শুরু হয় র‌্যাব-পুলিশের তৎপরতা। ভোরে অপহরণকারীরা ফাতেমাকে উত্তরায় ছেড়ে দেয়। ফাতেমা তার মাকে ফোন করলে বাবা-মা গিয়ে তাকে উদ্ধার করে পুলিশকে জানায়। পরে পুলিশ তাকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে অপহরণকারীদের সম্পর্কে জানার জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করে। এর আগে রাতেই অভিযান চালিয়ে পুলিশ প্রেমিকদের একজন ব্যবসায়ী রুম্মন এবং তার দুই ভাই ও পিতাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে।

ফাতেমার মা নুরুন্নাহার সাইফুল বলেন, ফাতেমা ক্যাম্রবিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। বেশ কিছুদিন আগে উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ৪/এ নম্বর রোডের ১৯ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা মাহফুজের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়। সপ্তাহ খানেক আগে তাদের দু’জনের আংটি বদলও হয়েছে। দুই পরিবারের সম্মতিতেই এ বিয়ে ঠিক করা হয়েছিল। হবু জামাই মাহফুজ তাদের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত করতে। বৃহস্পতিবার ইফতারের পর মাহফুজ এসে সবাইকে বাইরে খাওয়ার জন্য নিয়ে যায়। হবু জামাইয়ের সঙ্গে মা-মেয়ে প্রথমে রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্সে যান। সেখানে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সেরে তারা হেলভেসিয়া রেস্টুুরেন্টে ডিনার করেন। রাত ১১টার দিকে তারা পায়ে হেঁটে উত্তরা চার নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর রোডের ৯ নম্বর বাসায় ফিরছিলেন। ওই বাসার ৩/এ ফ্ল্যাটের বাসিন্দা তারা। তিন নম্বর সড়কের ৬ নম্বর বাসার সামনে আসার পরই ৪-৫ জন অপরিচিত যুবক তাদের পথরোধ করে। তারা ফাতেমাকে জোর করে গাড়িতে তুলে নেয়ার চেষ্টা করে। এসময় তিনি ও মাহফুজ মিলে ফাতেমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে তারা চাপাতি দিয়ে মাহফুজের হাতে আঘাত করে। এসময় তাদের চিৎকারে পাশের ৬ নম্বর বাসার দারোয়ান লিটন এগিয়ে আসেন। তিনি মাইক্রোবাস থেকে ফাতেমাকে বের করতে গেলে তারা লিটনের পেটে গুলি করে পালিয়ে যায়। তিনি বলেন, কলেজে পড়ার সুবাদে ফাতেমার অনেক বন্ধু ছিল। তাদের সঙ্গে প্রায় সময় মোবাইল ফোনে কথা বলতো। তিনি বলেন, শুধু কলেজের ছাত্ররাই না ফাতেমা বেশ কয়েকবার আমাকে বলেছে তার কলেজের দু’জন শিক্ষক তাকে প্রায়ই উত্ত্যক্ত করতো। এমনকি তাকে প্রেম নিবেদনও করেছে। আমার ধারণা ফাতেমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে জেনে ওই দুই শিক্ষক বিপ্লব ও আদ্রিন অথবা অন্য কেউ ফাতেমাকে অপহরণ করেছিল। অপহরনের ৭ ঘণ্টা পর ভোরের দিকে অপহরণকারীরা তাকে ছেড়ে দেয়।
পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার নিশারুল আরিফ জানান, এ ঘটনায় ফাতেমার মা নুরুন্নাহার বাদি হয়ে উত্তরা মডেল থানায় একটি মামলা করেছে। সন্দেহভাজন হিসেবে রুম্মন, তার দুই ভাই ও বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তবে ফাতেমাকে কে বা কারা অপহরণ করেছে তা এখনো জানা যায়নি। তিনি বলেন, অপহরণকারীরা জানতো মা-মেয়ে ও হবু জামাই বাইরে বেড়িয়েছে। অপহরণকারীরা তাদের অনুসরণ করেছে। একই সঙ্গে বাসায় যাওয়ার পথে মাইক্রোবাস নিয়ে আগে থেকেই ওত পেতে থাকে। তিনি বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে ফাতেমাকে অপহরণকারীদের হাত থেকে বাঁচাতে গেলে ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা যুবক নিরাপত্তাকর্মী লিটনকে গুলি করে। অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে।
সৌদি যাওয়ার কথা ছিল লিটনের: পরোপকার করতে গিয়ে অপহরণকারীদের হাতে নিহত নিরাপত্তকর্মী লিটন কয়েক দিন পরই সৌদি আরব যাওয়ার কথা ছিল। পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে সব প্রস্তুতও হয়েছিল। কিন্তু যাওয়া আর হলো না। পরোপকার করতে গিয়ে নিজের জীবন বিলিয়ে দিলেন তিনি। যেই বাসায় লিটন নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন ওই বাসার এক বাসিন্দা জানান, গুলিতে আহত হওয়ার পর লিটনকে উদ্ধার করে উত্তরার বাংলাদেশ মেডিকেল ও সেন্ট্রাল হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ কেস হওয়ায় কেউ তাকে চিকিৎসা করতে রাজি হননি। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। নিহতের শ্যালক হুমায়ূন কবীর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, প্রায় ৩ মাস আগে তার দুলাভাই কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় এসে তিনি ওই বাসায় নৈশপ্রহরীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার সৌদি আরব যাওয়ার কথা ছিল। ভিসা ও পাসপোর্ট সব প্রস্তুত করা হয়েছিল। আমার ছোট ছোট দু’জন ভাগ্নে রয়েছে। তাদের এখন কে লালন পালন করবে? তিনি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন। একই সঙ্গে পরোপকার করতে গিয়ে নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়া লিটনের পরিবারের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার আহ্বানও জানান তিনি। কবীর জানান, নিহত লিটনের পিতার নাম নাজমুল হুদা। তার গ্রামের বাড়ি রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার ইটাকুমারীর নামাপাড়া এলাকায়।
উৎসঃ   মানবজমিন