শনিবার, জুলাই ০৫, ২০১৪

অন্ধেরাও চালাবে কম্পিউটার...

বাংলাদেশের জন্য গর্ব বয়ে এনেছে 'বাংলা ব্রেইল' প্রকল্প। দেশের হাজারো দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের কাছে তাদের উপযোগী করে পাঠ্যপুস্তক পৌঁছে দেওয়ার এক মহত্ উদ্যোগ এই 'বাংলা ব্রেইল'। জার্মানির ডয়চে ভেলের 'দ্য ববস' প্রতিযোগিতায় সেরা উদ্ভাবন ক্যাটাগরিতে জুরি এবং পিপলস চয়েজ অ্যাওয়ার্ড জয় করে নিয়েছে এই প্রকল্পটি।

যেভাবে শুরু

আমাদের দেশে এখন বছরের শুরুতেই সকল শিক্ষার্থীর হাতে পাঠ্যবই পৌঁছে গেলেও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি বইগুলো একদিকে যেমন উচ্চমূল্যের, তেমনি সেগুলো তৈরিতে নানা ধরনের কারিগরি সমস্যাও রয়েছে। ফলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের হাতে তাদের উপযোগী বই পৌঁছে দেওয়াটা আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে সহজ বিষয় নয়। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে এটি নিয়ে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়, যাতে বলা হয় বছরের অর্ধেক পেরিয়ে গেলেও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের কাছে পৌঁছায়নি পাঠ্যপুস্তক। সেই প্রতিবেদনটি চোখে পড়ে ড. রাগিব হাসানের যিনি শিক্ষক ডটকমের (http://shikkhok.com) প্রতিষ্ঠাতা ও ডিজিটাল শিক্ষক হিসেবে ইতোমধ্যেই পরিচিত হয়ে উঠেছেন সকলের কাছে। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেও তিনি এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ইন্টারনেট ব্যবহার করে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলে এই কঠিন কাজটি সহজ হয়ে উঠবে বলেই বিশ্বাস ছিল তার। আর তাই সকলের অংশগ্রহণের একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবেই তিনি গড়ে তোলেন বাংলা ব্রেইল প্রকল্প। বাংলাব্রেইল ডটঅর্গ (www.banglabraille.org) নামে একটি ওয়েবসাইট এবং একই নামে ফেসবুকে একটি গ্রুপ (www.facebook.com/groups/banglabraille) খুলে তিনি কাজ শুরু করে দেন। তার ডাকে সাড়া দিয়েই দেশের নানা প্রান্তের মানুষজন যোগ দেন এই প্রকল্পে। আর তারপর থেকে তারা তৈরি করে যাচ্ছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের উপযোগী সব পাঠ্যবই।

'ক্রাউডসোর্সিং' পদ্ধতিতে কাজ করছে বাংলা ব্রেইল প্রকল্প

বাংলা ব্রেইল আসলে একক কোনো মানুষ বা প্রতিষ্ঠাননির্ভর কোনো প্রকল্প নয়। অনলাইনে মুক্ত এই প্রকল্পে যে কেউ যেকোনো অবস্থান থেকেই অংশগ্রহণ করতে পারে তার সামর্থ্য অনুযায়ী। বাস্তবেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ যুক্ত হয়ে সমৃদ্ধ করে চলেছেন বাংলা ব্রেইলকে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য পাঠ্যপুস্তক তৈরির এই প্রকল্প মূলত কাজ করে দুইটি ভাগে। এর একটি ভাগে শিশুদের জন্য ব্রেইল ভাষায় ছাপার উপযোগী বই তৈরি এবং অপর ভাগে বইয়ের অডিও সংস্করণ তৈরির কাজ হয়ে থাকে। ড. রাগিব হাসান জানান, ইতোমধ্যেই তিন হাজারেরও বেশি মানুষ এই প্রকল্পে বিভিন্ন উপায়ে অবদান রেখে চলেছেন। একটি নির্দিষ্ট প্রকল্পে অনলাইনে বিভিন্ন স্থান থেকে যোগ দেওয়া এমন অনেক মানুষের অংশগ্রহণকেই বলা হয় ক্রাউডসোর্সিং।

ব্রেইলে ছাপা বইয়ের জন্য ইউনিকোড সংস্করণ

ব্রেইল পদ্ধতিতে বই ছাপার জন্য সাধারণত বইয়ের টেক্সটের ইউনিকোড সংস্করণ প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের দেশের পাঠ্যপুস্তকগুলোর এই ইউনিকোড সংস্করণ সহজলভ্য নয়। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ওয়েবসাইটে পাঠ্যপুস্তকের যেসব ডিজিটাল সংস্করণ আপলোড করা রয়েছে, সেগুলো আসলে মূল বইয়ের স্ক্যান করা পিডিএফ কপি। সরকারের ই-বুক ওয়েবসাইটে ই-বুক সংস্করণ থাকলেও সেখানে নেই বইয়ের মূল টেক্সটের ইউনিকোড সংস্করণ। পাঠ্য বইয়ের অপ্রতুল এই ইউনিকোড টেক্সট ফরম্যাট নিয়েই কাজ করে যাচ্ছে বাংলা ব্রেইল প্রকল্প। এখানে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বইয়ের নাম উল্লেখ করে দেওয়া হয়। আগ্রহীরা সেসব বইয়ের টেক্সটগুলোর ইউনিকোড সংস্করণ টাইপ করে দেন। এখানকার একটি বড় সুবিধা হলো নির্দিষ্ট কাউকে অনেক কাজ করতে হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ১০০ পৃষ্ঠার একটি বই ১০ জন মিলে টাইপ করে ফেলছেন।

তৈরি হচ্ছে অডিও বুক

ব্রেইল পদ্ধতিতে ছাপা বই নিয়ে কাজ করা বেশ সময়সাপেক্ষ বলে এর মধ্যে বিকল্প আরেকটি পন্থাও গ্রহণ করেছে বাংলা ব্রেইল প্রকল্প। তারা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্রতিটি বইয়ের অডিও বুক তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছে। এই কাজটিও হচ্ছে আগের কাজটির অনুরূপ পদ্ধতিতেই। কোনো একটি বইয়ের নাম জানিয়ে দেওয়া হলে আগ্রহীরা সেই বইয়ের নির্দিষ্ট অধ্যায় বা নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা নিজে নিজেই পাঠ করে সেটা ধারণ করে অডিও বুক তৈরি করে ফেলছেন। বইয়ের সকল অংশের অডিও জমা পড়লে তাকে একসাথে করে চূড়ান্ত করা হচ্ছে পুরো বইয়ের অডিও সংস্করণ।

উত্সর্গ দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের

ডয়চে ভেলের দ্য ববস পুরস্কার বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত একটি সম্মানজনক পুরস্কার। প্রকল্পের সমন্বয়ক ড. রাগিব হাসান বলেন, 'বাংলা ব্রেইল প্রকল্পের পক্ষ থেকে দ্য ববস-এর অ্যাওয়ার্ডটি গ্রহণ করে খুবই ভালো লাগছে। দৃষ্টিহীন শিশুদের জন্য হাজারো মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে সবসময় প্রস্তুত আছেন আর ক্রাউডসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সামাজিক অনেক সমস্যাকে সমাধান করা সম্ভব, বাংলা ব্রেইল প্রকল্পটি এরই প্রমাণ।' তিনি আরও বলেন, 'এই পুরস্কার আমি বাংলাদেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য উত্সর্গ করছি। জ্ঞানের আলো পাওয়ার অধিকার সকলের সমান, আগামী দিনে এটা সুনিশ্চিত হবে—এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।'