শনিবার, জুলাই ০৫, ২০১৪

তাকওয়ার অধিকারী হবার জন্যেই রোজা আর মুত্তাকীদের জন্যেই জান্নাত প্রস্তুত

রোজা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও আত্মশুদ্ধির এক মহান খোদায়ী ব্যবস্থা। চারিত্রিক সকল মহৎ গুণাবলী সৃষ্টির এক বিশেষ অনুশীলন। জীবনের সকল স্তরে খোদায়ী ন্যায় বিধানের উপর ধৈর্য-সহনশীলতার সাথে অটল থাকার একটি প্রশিক্ষণ। যাবতীয় কষ্ট ও প্রতিকূলতার মাঝেও আল্লাহর উপর নির্ভরশীল দৃঢ়চিত্ততার এক নিদর্শন। বল্গাহীন অসৎ প্রবণতা তাড়িত জীবনকে নিয়ন্ত্রণে আনার এক ট্রেনিং। রোজার আরবী শব্দ হলো সওম ও সিয়াম। এর আভিধানিক অর্থ চলমান কিছুর হঠাৎ থেমে যাওয়া। ইসলামের পরিভাষায় সোবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও কামাচার থেকে বিরতে থাকার নাম রোজা বা সওম। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের গতি এ রমযান মাস আসলে থেমে যায়। আরবী ১২ মাসের মধ্যেও এ মাসের প্রথম সোবহে সাদিক থেকে মানুষের এক নতুন কর্মসূচি ও নতুন জীবন-চেতনার দ্বারা গোটা মাস পরিচালিত হয়। দেহ-মনের সকল অসৎপ্রবণতা ও কামনা-বাসনাকে কড়া নিয়ন্ত্রণে আনে। ষড়রিপুর বাড়াবাড়ি পদে পদে হয় বাধাপ্রাপ্ত। রমযানের সিয়াম সাধনা ইবাদত অনুশীলনের দ্বারা পরিশুদ্ধ আত্মাই আল্লাহর রহমত, বরকত ও মাগফেরাত পাবার যোগ্য।

মানব সমাজে বিরাজমান সকল দ্বন্দ্ব-সংঘাত-কলহ, বিবাদ, হানাহানি, মারামারি ইত্যাদি অশান্তির মূলে রয়েছে যুলুম বেইনসাফী। আর বেইনসাফী এবং যুলুম অন্যায়ের মূল অনুপ্রেরক হলো কলুষিত অন্তর, অপরিশোধিত আত্মা। দুর্নীতি ও পাপপ্রবণ আত্মার পরিশুদ্ধি যতদিন না ঘটবে, মানুষ যেমন তার স্রষ্টার সরল শান্তিপথ পাবে না, তেমনি তার দ্বারা স্বাভাবিকভাবেই সমাজে পাপাচার, দুর্নীতি যুলুম-নিপীড়নমূলক কাজের প্রসার ঘটবে। অনৈতিকতা ও সামাজিক অনাচার এহেন আত্মার দ্বারাই প্রশ্রয় পায়। এ থেকেই মানব সমাজে অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। আল্লাহ সৃষ্টির সেরা মানব জাতিকে এ অশান্তির হাত থেকে রক্ষাকল্পে মানুষের চরিত্রে আল্লাহভীতিপূর্ণ সতর্ক ভাবধারা সৃষ্টি করাই সকল খোদায়ী বিধানের লক্ষ্য। পবিত্র এবং কলুষতামুক্ত আত্মাই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের যোগ্য। আত্মাকে সেভাবে যোগ্য করার জন্যেই তিনি তার অন্যান্য বিধানসহ মানুষের প্রতি সিয়াম সাধনাকে ফরয করেছেন। যথার্থ রোজা পালন এবং আনুষঙ্গিক বিষয়সমূহের পূর্ণ অনুসরণ রমযান শেষে একজন রোজাদারকে আদর্শ চরিত্রের অধিকারী করার জন্যে যথেষ্ট। বলাবাহুল্য, পরিশুদ্ধ আত্মার এ সকল মানুষই আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের অনুপম আনন্দ লাভ করবে এবং তার প্রদত্ত পুরস্কার পাবার যোগ্য বলে বিবেচিত হবে।

মানুষের জন্য ইহ-পরকালের কল্যাণবাহী এই ইবাদত সুষ্ঠুভাবে পালিত হবার ওপরই এর কল্যাণকারিতা নির্ভরশীল। এজন্যে যেমন রোজা পালনের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রতিটি রোজাদারের স্পষ্ট ধারণা থাকা কর্তব্য, তেমিন এর নিয়মবিধি সম্পর্কেও অবগতির প্রয়োজন আছে বৈ কি।

রোজার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে, ‘‘পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ন্যায় তোমাদের উপরও এটি ফরয করা হলো “লাআল্লাকুম তাত্তাকূন” যেন তোমরা তাকওয়া অর্থাৎ খোদাভীতিপূর্ণ সতর্কজীবন ধারার অধিকারী হও।’’ বলা বাহুল্য, ন্যায়-অন্যায়, সুনীতি-দুর্নীতি, হালাল-হারাম ইত্যাদির যে সীমারেখা আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দিয়েছেন, মানুষ আল্লাহর ভয়ে জীবনের সকল ক্ষেত্রে সেই সীমারেখা মেনে চললেই মুত্তাকী হবে অর্থাৎ সতর্ক ও সাবধানী জীবনের অধিকারী হবে আর এই মুত্তাকীদের জন্যেই বেহেশতের খোশ-খবর দিয়ে আল্লাহ বলেছেন, ‘‘উয়িদ্দাৎ লিল মুত্তাকীন”Ñ বেহেশ্ত মুত্তাকীদের জন্যই তৈরি করা হয়েছে।’’ রমযানের সিয়াম সাধনা আমরা প্রতি বছরই করে থাকি কিন্তু আমাদের চরিত্রে তাকওয়া কতদূর আসে, আমরা কতদূর মোত্তাকী হই, না রমযান-পূর্বকালীন তাকওয়া পরিপন্থী ধ্যান-ধারণা ও কার্যধারাই আমাদের চরিত্রে প্রভাবশীল থাকে, তা অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে। রোজার অনুশীলন দ্বারা মুত্তাকী হতে না পারলে জান্নাত তৈরি থাকার খোশ-খবরী’র আশা করা বৃথা বলেই প্রমাণিত হবে।

ই‘তিকাফ ও শবেক্বদর

ইবাদতের উদ্দেশ্যে সাংসারিক কাজকর্ম হতে অবসর গ্রহণ করে মসজিদেই অবস্থান করাকে ই‘তিকাফ বলা হয়। হানাফী মতে ই‘তিকাফ ৩ প্রকার:

১. ওয়াজিব ই‘তিকাফ : নযর ও মান্নতের ই‘তিকাফ এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। কোনো ব্যক্তি যদি মনস্থ করে যে, আমার অমুক কাজ সমাধা হলে বা অমুক আশা পূর্ণ হলে আমি ই‘তিকাফ করবো অথবা এমনিতেই যদি কেউ নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত ই‘তিকাফ করার নিয়ত করে, তবে তার উপর এ ই‘তিকাফ ওয়াজিব হয়ে যায় এবং নিয়তকৃত মেয়াদপূর্ণ করা তার জন্য কর্তব্য।

২. সুন্নত ই‘তিকাফ : রমযান শরীফের শেষ দশ দিনের ই‘তিকাফ এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ (সা.) এ দিনসমূহে ই‘তিকাফ করেছেন। রমযানের বিশ তারিখ সন্ধ্যা অর্থাৎ সূর্যাস্তের সময় থেকে তা শুরু করতে হয়। এবং ঈদের চাঁদ দেখা পর্যন্ত এর মেয়াদ। এই ই‘তিকাফ সুন্নাতে মোয়াক্কাদা-এ-কেফায়া।

৩. মুস্তাহাব বা নফল ই‘তিকাফ : ওয়াজিব এবং সুন্নত ই‘তিকাফ ছাড়া সব ই‘তিকাফই মুস্তাহাব। বছরের সকল দিনেই এ ই‘তিকাফ পালন করা যায়। ফযীলতের কারণে স্বল্প মেয়াদের জন্যে হলেও সকলের ই‘তিকাফে যাবার চেষ্টা করা উচিত।

রমযানের বিশ তারিখ বহু রোজাদার মসজিদে ই‘তিকাফে বসেন। দুনিয়াবী সকল চিন্তা-ভাবনা ও কায়কারবার থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে রমযানের শেষ দশদিন কোনো মসজিদের এক কোণে অবস্থান নেন। ই‘তিকাফের অনেক সওয়াব রয়েছে। খোদ আল্লাহর রসূল ই‘তিকাফের ব্যাপারে যতœবান ছিলেন। ই‘তিকাফের দ্বারা নির্ঝঞ্ঝাটের মধ্যে থেকে একনিবিষ্ট চিত্তে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা যায়। এ সময়টির মধ্যে কায়মনোবাক্যে কুরআন পাঠ, নফল নামায, যিকির-ফিকির, তসবীহখানী, মুনাজাত ইত্যাদির মধ্য দিয়ে একজন লোক আত্মশুদ্ধির এক মহত্তর স্তরে নিজেকে পৌঁছাতে পারে। মহাপ্রভু আল্লাহ তা‘আলার নিকট তার কোনো ভক্তের সম্পূর্ণ একাকিত্বে অখ- মনে দোয়া মুনাজাত করা এবং তাঁর স্মরণে নিয়োজিত থাকা এমনিতেও অতি প্রিয় কাজ। পরন্তু মাহে রমযানের পুণ্যময় দিবস-রজনী একই অবস্থায় ই‘তিকাফে থাকাটা যে আত্মশুদ্ধির জন্যে কত বেশি সহায়ক তা সহজেই অনুমেয়।

রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, রমযান মাসের একটি নফল ইবাদত অন্য মাসের একটি ফরযের সমতুল্য এবং এ মাসের একটি ফরয অন্য মাসের সত্তুরটি ফরযের সমতুল্য। বলা বাহুল্য, এসব কিছু ফযীলত নির্ভর করে ইবাদতকালে একাগ্রচিত্ততার উপর। ই‘তিকাফ মুহূর্তে যেহেতু এ মনোভাব প্রবল থাকে তাই এজন্যে সওয়াব বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক।

রমযানে তারাবীহ, নফল নামায, কুরআন অধ্যয়ন, যিকির-ফিকির, তাসবীহখানী ইত্যাদি কাজ হুকুমের দিক থেকে অপরিহার্যতার পর্যায়ভুক্ত না হলেও আরও নানান দিকের বিচারে এগুলোর সওয়াবের পরিমাণ রমযান মাসে অধিক হয়ে থাকে। যেমন পবিত্র কুরআন মজীদে আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘তারা আপন প্রভুর উদ্দেশে নামাযে দ-ায়মান এবং সিজদার মধ্য দিয়ে রাত্রি যাপন করে। আর এ বলে আমার নিকট প্রার্থনা জানায় যে, ‘‘হে প্রভু! আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তিকে দূরে সরিয়ে রাখো।’’ কুরআন মজীদের অন্যত্র মহানবীর প্রতি ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে রাতে ঘুম থেকে জাগা কুপ্রবৃত্তির দমনের একটি কঠোর পন্থা। এবং বক্তব্য হিসেবে সুদৃঢ়। দিনের বেলা তোমার অনেক ব্যস্ততা থাকে। সুতরাং রাতের বেলা তোমার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করো এবং সকল কিছুর সম্পর্ক ছিন্ন করে একমাত্র তাঁর দিকেই রুজু হয়ে যাও। উল্লেখ্য, যে, মহানবীর দিনের বেলার কর্মতৎপরতা নবুয়তী কাজের বাইরে ছিল না, তার পরও রাতের গভীরে আল্লাহ্র প্রতি সম্পূর্ণ রুজু হবার নির্দেশ থেকে একান্ত আল্লাহ্র ধ্যানের গুরুত্বই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের এ মহৎ কাজগুলো মাহে রমযানের মধ্যে বিশেষ করে রাতের অংশে এবং ই’তিকাফে ও মহিমান্বিত শবেক্বদরে অধিক কল্যাণবাহী হয়ে থাকে। আর এমনি করে এগুলো রোযার অপরিসীম সওয়াব প্রাপ্তিতে ও রোযার মূল লক্ষ্য অর্জনে সোনায় সোহাগার কাজ করে। একেক খোদাপ্রেমিক রোযাদারের মর্যাদাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এভাবে ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নাত-নফল ইত্যাদি আমলের সওয়াবের অধিকারী ব্যক্তি সম্পর্কেই হাদীসের সে শুভ সংবাদ প্রযোজ্য হয়, যেখানে বলা হয়েছে যে ব্যক্তি যথারীতি রমযানের রোযা পালন করে সে যেন সদ্য জন্মা নিষ্পাপ শিশুর ন্যায় মাসুম- বেগুনাহ বান্দাহ্য় পরিণত হয়। আল্লামা ইব্নে কাইয়েম বলেন, ই’তিকাফের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য হলো আল্লাহ্র ইচ্ছার সাথে নিজেকে একাকার করে নেয়া। ই’তিকাফকারী দুনিয়ার সব ভুলে গিয়ে প্রভুপ্রেমে এতই বিভোর হয়ে পড়ে যে, তার সকল ধ্যানধারণা, চিন্তা-ভাবনা একমাত্র আল্লাহ্কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। সংসারের সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে একমাত্র আল্লাহ্র সাথেই সম্পর্ক স্থাপন করা। এ সম্পর্ক ও ভালোবাসা তার কবরের সঙ্গী-সাথীহীন অবস্থায় সহায়ক হবে।

মারাকিউল ফালাহ্ কিতাবে উল্লিখিত আছে ই’তিকাফ আন্তরিক নিষ্ঠা সহকারে পালিত হলে তা বান্দাহ্র আমলসমূহকে উত্তমতার চূড়ান্ত মনযিলে পৌঁছায়। কারণ, এতে বান্দাহ্ দুনিয়ার সকল কিছুর মায়া ভুলে একমাত্র আল্লাহ্রই পানে মুখ ফিরায়। সর্বতোভাবে প্রভুর চরণতলে আত্মনিবেদন করে এবং তাঁরই দুয়ারে মাথা ঠোকে। তদুপরি ই’তিকাফের প্রতিটি মুহূর্ত ইবাদতের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। কেননা ই’তিকাফকারীর শয়ন-স্বপন সবকিছুই ইবাদতের মধ্যে গণ্য। তিনি সর্বক্ষণ আল্লাহ্র নৈকট্য লাভে ধন্য হন। হাদীস শরীফে আছে, যে ব্যক্তি আমার প্রতি এক বিঘত অগ্রসর হয় আমি তার পানে এক হাত অগ্রসর হই। যে আমার দিকে হেঁটে আসে আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।

মাসআলা

পুরুষের জন্যে ই’তিকাফের সর্বোত্তম স্থান হলো মক্কা শরীফের মসজিদ, অতঃপর বায়তুল মুকাদ্দাসের মসজিদ, তারপর ঐ মসজিদ যেখানে জুমার জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়।

ইমাম আযম আবূ হানীফা (রঃ)-এর মতে, যে মসজিদে পাঞ্জেগানা নামায জামাতে আদায় করা হয়, কেবল সে মসজিদে ই

ই’তিকাফ করা চলে। ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদের মতে শরীয়তের দৃষ্টিতে যে মসজিদ ‘মসজিদ’ বলে স্বীকৃত, তাতে পাঞ্জেগানা জামাত রীতিমতো না হলেও ই’তিকাফ করা দুরস্ত আছে।

মহিলাদের ই’তিকাফ

মহিলারা পারিবারিক পরিম-লে মহিলাদের জন্যে নির্দিষ্ট মসজিদ বা নামাযের কামরায় ই’তিকাফ করবেন। কোন নির্দিষ্ট স্থান না থাকলে ঘরের কোন একটি নির্জন কোণে ই’তিকাফের জন্য বেছে নেয়া উচিত। পুরুষের তুলনায় স্ত্রীলোকের ই’তিকাফ সহজসাধ্য! তারা ঘরের অন্যের দ্বারা গৃহকর্ম করিয়ে সংসার ধর্ম চালিয়ে যেতে পারেন অথচ ই’তিকাফের সওয়াবেরও অধিকারী হতে পারেন। আমাদের মহিলা সমাজের জন্যে পারিবারিক পরিম-লে শিশুদের হৈ চৈ কিংবা অন্যদের কথাবার্তার আওয়াজ থেকে দূরে থেকে একনিবিষ্টচিত্তে আল্লাহ্র ইবাদতের সুযোগ পালন খুব কমই হয়ে থাকে। এ ব্যাপারটির প্রতি যাদের সামর্থ্য আছে তারাও গুরুত্ব দেন না। অথচ নির্জন পরিবেশ ছাড়া ঘরের লোকদের কথাবার্তা ও ছেলেমেয়েদের আনাগোনার মধ্যে নামায, ইবাদত কিছুই ঠিকমতো মন দিয়ে করা যায় না।

ই’তিকাফে যেসব কাজ জায়েজ

১. পেশাব-পায়খানার প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া, ২. গোসল ফরয হলে গোসলের জন্যে বের হওয়া, ৩. জুমার নামাজের জন্যে (বেলা ঢলে যাবার পর কিংবা এতটুকু আগে বের হওয়া যেন জামে মসজিদে গিয়ে খুৎবার আগে চার রাকাত সুন্নত পড়া যায়), ৪. পেশাব-পায়খানার জন্যে জায়গা যতদূরেই হোক যেতে পারবে, ৫. মসজিদে খানা-পিনা, শোয়া, দরকারি কিছু কিনে নেয়া যা মসজিদে নেই, জায়েজ রয়েছে। বিবাহ অনুষ্ঠানেও বাধা নেই।

যেসব কারণে ই’তিকাফ নষ্ট হয়

১. ই’তিকাফ অবস্থায় স্ত্রীর শয্যাসঙ্গী হওয়া, যদিও সেটা ভুলেই হয়ে যাক না কেন।

২. বিনা ওজরে ইচ্ছাকৃতভাবে বাইরে যাওয়া।

৩. কোন ওজরে মসজিদ থেকে বাইরে যাবার পর প্রয়োজনতিরিক্ত সময় সেখানে অবস্থান করা।

৪. রোগ কিংবা ভয়জনিত কারণে মসজিদ থেকে বের হওয়া। এ সকল অবস্থায় ই’তিকাফ বিনষ্ট হয়।

যে সকল কারণে ইতিকাফ মাকরূহ হয়

(১) সম্পূর্ণ নীরব থাকা এবং কারুর সাথে আদৌ কথা না বলা,

(২) মসজিদে পণ্য সমগ্রীর ক্রয়-বিক্রয়,

(৩) কলহদ্বন্দ্ব ও বাজে কথা চর্চা করা।

ইতিকাফে মুস্তাহাব কাজ

(১) কথা বলার সময় নেকীর কথা বলা।

(২) কুরআন মজীদ অধ্যয়ন করা।

(৩) দরূদ শরীফ পড়া।

(৪) নফল নামায পড়া।

(৫) দীনি ইলম হাসিল করা কিংবা অপরকে শিক্ষাদান করা।

(৬) ওয়াজ-নসীহত করা।

(৭) মসজিদে ইতিকাফ করা।

হযরত আবু সাঈদ (রা.) বলেন, একদা রমযান মাসে রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রথম দশকে ই’তিকাফ করলেন। তারপর মধ্যবর্তী দশকেও। অতঃপর তিনি যে তাঁবু খাটিয়ে ই’তিকাফ করছিলেন, সেই তুর্কী তাঁবুর মধ্য হতে মাথা বের করে আমাদের সম্বোধন করে বললেন, আমি শবে কদরের প্রথম দশক ই’তিকাফে কাটালাম। অতঃপর মধ্যবর্তী দশকও কাটালাম। তারপর এক আগন্তুক ( ফেরেশতা)-এর মাধ্যমে আমাকে জানান হলো যে, এটা শবেক্বদর মাসের শেষ দশক। সুতরাং যারা আমার সাথে ই’তিকাফে আছে, তাদের শেষ দশকেও ই’তিকাফে কাটানো উচিত। আমাকে এ রাতটি দেখানো হয়েছিল। কিন্তু পরে তা আমাকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি সে রাতের প্রত্যুষে কাদা-মাটিতে সিজদা করেছি।

সুতরাং তোমরা রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতসমূহে শবেক্বদরের অনুসন্ধান করো। বর্ণনাকারী সাহাবী বলেন, সে রাতটিতে বৃষ্টি হয়েছিল। মসজিদ ছিল ছাপড়ার। বৃষ্টির ফলে ছাদ দিয়ে পানি ঝরছিল। আমি স্বচক্ষে সেই ভোরে রাসূল করীম (সা.)-এর ললাটে কাদা-মাটির চিহ্ন দেখেছি। এটা ছিল ২১শে রমযানের ভোর বেলা।

শবেক্বদর : মহিমান্বিত রাত

আল্লাহ তা’আলা গোটা বছরের সকল রাতের মধ্যে যে একটি রাতের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, সেটি হলো ‘লাইলাতুল ক্বদর’-মর্যাদার রাত। তাঁর ভাষায়-

‘‘আমি একে (কুরআন) মর্যাদার রাত লাইলাতুল ক্বদরে অবতীর্ণ করেছি। ক্বদর রজনীর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে আপনি অবগত আছেন কি? কদর রজনী হচ্ছে হাজার মাসের চাইতে শ্রেষ্ঠ। অসংখ্য ফেরেশতা ও জিবরাইল ঐ রাতে তাদের প্রভুর অনুমতিক্রমে প্রতিটি কল্যাণের বস্তু নিয়ে যমীনে অবতীর্ণ হন। এ রাতটি আগাগোড়াই শান্তিময়-সালাম। এমনকি ফজর তথা সুবহে সাদিক প্রকাশ পাওয়া পর্যন্ত তা চলতে থাকে।’’

এ রাতের মর্যাদা সম্পর্কে দু’একটি হাদীস এখানে উদ্ধৃত করছি ঃ (১) হযরত আবু হুরায়রার বর্ণনা মতে- রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ক্বদরের রাতে সওয়াব হাসিলের আশায় (ইবাদতের জন্যে) দাঁড়ায় তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। -(তারগীব বুঃ মঃ উদ্ধৃতিসহ)। হযরত উমর (রা.) এশার নামায পড়ে ঘরে তশরীফ নিয়ে যেতেন এবং ফজর পর্যন্ত নফল নামায পড়ে রাত কাটিয়ে দিতেন। হযরত উসমান (রা.) সারাদিন রোজা রাখতেন।

শবে কদর রহস্যাবৃত থাকা সম্পর্কে ওলামা-এ মুহাদ্দেসীনের মত হলো এই যে, (১) নির্দিষ্ট করা হলে অনেক গাফেল লোক অন্যান্য রাতে ইবাদত করাই ছেড়ে দেবে। (২) অনেক লোক রয়েছে যারা পাপকর্ম ছাড়া থাকতে পারে না। তারিখ নির্ধারিত থাকলে যদি জেনেশুনে কোন ব্যক্তি পাপকর্মে লিপ্ত হতো, তবে সেটা তার জন্যে অধিক বিপজ্জনক হতো। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা প্রণিধানযোগ্য।

একবার নবী করীম (সা.) দেখলেন, এক সাহাবী মসজিদে ঘুমাচ্ছেন। তিনি হযরত আলীকে বললেন, আলী যেন ঘুমন্ত ব্যক্তিকে জাগিয়ে ওযু করতে বলেন। হযরত আলী এ নির্দেশ পালন করার পর হুযুরকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি তো সকল পুণ্যকাজেই অগ্রগামী, এ ব্যাপারে আপনি নিজে তাকে না বলে আমাকে দিয়ে জাগানো ও বলানোর তাৎপর্য আছে কি? হুযুর (সা.) বললেন, আমার ভয়, ঘুমের ঘোরে পাছে সে ব্যক্তি গাত্রোত্থান করতে অসম্মত হয় আর নবীর কথা অমান্য করায় কুফরীতে নিপতিত হয়ে পড়ে। তোমার কথায় অস্বীকৃতি জানালে কুফরী হতো না। (৩) শবেক্বদর নির্দিষ্ট থাকলে এবং ঘটনা চক্রে কোন ব্যক্তি উক্ত রাতে ইবাদত হতে বঞ্চিত হলে, এ শোকে সে পরবর্তী রাতগুলোতে আর ইবাদতের জন্যে জাগতে পারতো না। (৪) শবেক্বদরের ইবাদত করার উদ্দেশ্যে যে সব রাতে জাগরণ করা হয়, সে সব রাতের স্বতন্ত্র নেকী পাওয়া যায়। সাহাবা-এ-কেরাম (রা.) রাতের নফল নামাযে এক এক রাকাতে পূর্ণ কুরআন শরীফ খতম করে দিতেন।

(২) হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন শবেক্বদর উপস্থিত হয়, তখন জিবরাইল (আ.) একদল ফেরেশতাসহ পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং দাঁড়ানো বা বসা অবস্থায় আল্লাহর স্মরণেরত বান্দাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন। তারপর ঈদের দিন যখন রোজা ভাঙ্গার সময় আসে, তখন আল্লাহ তা’আলা ফেরেশতাদের কাছে তাঁর বান্দাদের নিয়ে গর্ব করে বলেন, ফেরেশতাগণ! মজুর তার কার্য সম্পাদন করলে তার প্রতিদান কি? জবাবে ফেরেশতাগণ আরয করলেন, প্রভু! পূর্ণ পারিশ্রমিক দান করাই তার প্রতিদান।... অতঃপর আল্লাহ তা’আলা বলেন, হে আমার বান্দারা! যাও, আমি তোমাদের মা’ফ করে দিলাম এবং তোমাদের পাপরাশিকে নেকীতে পরিবর্তিত করে দিলাম।

শবেক্বদর রহস্যাবৃত থাকার তাৎপর্য

রমযানের শেষ দশদিনের বেজোড় রাতগুলোর কোন একটিতে শবেক্বদর হয়ে থাকে। এর প্রত্যেকটিতে এ মহিমান্বিত রজনীটি অনুসন্ধান করার জন্য রাসূল (সা.) হুকুম করেছেন।

বলা বাহুল্য, এদিক থেকে ই’তিকাফে উপবিষ্ট ব্যক্তিরাই অতি ভাগ্যবান। কেননা তারা রমযানের শেষ দশদিনের প্রত্যেকটি দিনেই সওয়াব লাভের সে সুযোগ নিতে পারেন। আল্লাহ আমাদের সকলকে রমযান, সিয়াম ও শবেক্বদরের নেকী লাভের পূর্ণ তওফীক দান করুন।